মিরসরাইয়ে আত্মঘাতী বোমায় দুই জঙ্গি নিহত, ২ রাইফেলসহ বোমা তৈরির বিপুল সরঞ্জাম উদ্ধার।

মিরসরাইয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক এবং ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের মাঝামাঝি এলাকায় এক জঙ্গি আস্তানায় অভিযান চালিয়েছে র‌্যাব। এ সময় আত্মঘাতী বোমায় দুই জঙ্গি নিহত হয়। উপজেলার জোরারগঞ্জ থানাধীন জোরারগঞ্জ ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের উত্তর সোনাপাহাড় গ্রামের একটি বাড়িতে এ অভিযান চলে। গতকাল বৃহস্পতিবার রাত ৩টা থেকে ওই বাড়িটি ঘিরে রেখে দীর্ঘ প্রায় ৮ ঘণ্টা অভিযান চালায়। অভিযানে রাইফেল, গ্রেনেডসহ বোমা তৈরির বিপুল সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। র‌্যাব ‘চৌধুরী ম্যানশন’ এ বাড়িটির মালিক ও কেয়ারটেকারকে আটক করে।
র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান জানান, ওই বাড়িতে অবস্থান নিয়ে জেএমবি সদস্যরা চট্টগ্রামে বড় ধরনের নাশকতার পরিকল্পনা করছিল। তাদের প্রাপ্ত তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করে এ অভিযানে নামে র‌্যাব। এতে র‌্যাবের দেড় শতাধিক সদস্য অংশ নেন। অভিযান শেষে চৌধুরী ম্যানশনের ওই সেমিপাকা বাড়ি থেকে একটি একে-২২ রাইফেল, ৫টি অবিস্ফোরিত গ্রেনেড, ৩টি পিস্তল, গোলাবারুদ, কয়েকটি বই এবং বোমা তৈরির বেশকিছু সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। এসময় বাড়িটির মালিক মাজহার চৌধুরী ও কেয়ারটেকার হকসাবকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়।
তিনি আরো জানান, বাড়ির মালিক মাজহার চৌধুরী ঠিকাদারী ব্যবসা করেন। তিনি থাকেন জোরারগঞ্জ বাজারের পাশে সিলমা প্যালেস নামের একটি ভাড়া বাড়িতে। অভিযানে গোলাগুলি ও বিস্ফোরণের কারণে বৃহস্পতিবার রাত ৩টার সময় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। তবে পুরাতন ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক দিয়ে স্বাভাবিকভাবে যান চলাচল করে। ভোর ৪টা ২২ মিনিটের সময় ওই বাড়িতে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটার পর গোলাগুলি বন্ধ হয়ে যায়। র‌্যাব বারবার মাইকিং করে জেএমবি সদস্যদের আত্মসমর্পণের জন্য অনুরোধ করলেও তারা আত্মসমর্পণ করেনি। বিস্ফোরণে বাড়ির টিনের ছাদ উড়ে যায়, নিহতদের লাশ ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে। পরে নিয়ন্ত্রিতভাবে আবার যানবাহন চলাচল শুরু হয়। ঢাকা থেকে সকাল ৯টায় বোমা নিস্ক্রিয়কারী দলের সদস্যরা এসে বাড়ির ভেতরে ও বাইরে তল্লাশি চালিয়ে অস্ত্র ও বিস্ফোরক এবং ২ জন অজ্ঞাত পুরুষের ছিন্নভিন্ন লাশ উদ্ধার করে।
র‌্যাব কর্মকর্তারা জানান, নারী জঙ্গিসহ জেএমবির ৪ সদস্য ওই বাড়িতে উঠেছিল বলে তাদের কাছে তথ্য ছিল। তবে বাড়িতে ওঠার পর ওই নারী সেখান থেকে চলে যায়। গত দুই মাসে বেশ কয়েকটি জঙ্গিবিরোধী অভিযান চালিয়ে র‌্যাব জানতে পারে, জেএমবির একটি গ্রুপ চট্টগ্রাম ও আশপাশের এলাকায় অবস্থান করছে এবং তাদের কাছে বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও গোলাবারুদ আছে। তারা একটি বড় ধরনের নাশকতার পরিকল্পনা করছে। খবর পেয়ে ওই বাড়ি চিহ্নিত করে ঘিরে ফেলে র‌্যাব। র‌্যাবের উপস্থিতি টের পেয়ে বাড়িটির ভেতর থেকে জঙ্গিরা গুলিবর্ষণ করে এবং বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। পরে বেশ কিছুক্ষণ গোলাগুলি চলার পর ভোর ৪টা ২২ মিনিটে ভেতরে বিস্ফোরণ ঘটে। বিস্ফোরণে পুরো ভবনের ভেতর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। বোমা নিস্ক্রিয়কারী দলের সদস্যরা ঘটনাস্থলে তল্লাশি চালিয়ে দুইটি আইইডি (ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস) পান, বাড়ির ভেতরে তল্লাশি চালিয়ে পাওয়া যায় আরও তিনটি আইইডি। বিস্ফোরকগুলো উদ্ধার করে বাড়ির পাশের খোলা জায়গায় বিস্ফোরণ ঘটান তারা। দুপুর দেড়টার সময় বাড়ি থেকে নিহতদের লাশ উদ্ধার করে প্রথমে জোরারগঞ্জ থানায় এবং পরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ময়নাতদন্তের জন্য নেওয়া হয়।

চট্টগ্রাম আদালতে
নাশকতার লক্ষ্য
ছিল জঙ্গিদের

জঙ্গিদের লক্ষ্য ছিল চট্টগ্রাম আদালতে নাশকতা চালানোর। তাই তারা পরিকল্পনামাফিক সোনাপাহাড়ের চৌধুরী ম্যানশন ভাড়া নেয়। র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান বলেন, চৌধুরী ম্যানশনে যেসব অস্ত্র ও বিস্ফোরক পাওয়া গেছে, তার মধ্যে একে টুয়েন্টি টু রাইফেল গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলায় ব্যবহৃত অস্ত্রের সাথে মিল রয়েছে।
তিনি আরো বলেন, ইতোপূর্বে গ্রেপ্তার হওয়া জঙ্গিদের জিজ্ঞাসাবাদ করে এবং র‌্যাবের বিভিন্ন উইংয়ের গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে তারা চট্টগ্রামে জেএমবির একটি গ্রæপের সক্রিয় থাকার তথ্য জানতে পারেন। সেই তথ্যের ভিত্তিতেই সোনাপাহাড়ে
অভিযান চালানো হয়। বাড়ি ভাড়া নেওয়া সবাই জেএমবির একটি গ্রæপের সদস্য। যাতায়াতের সুবিধার জন্য মহাসড়কের পাশে ওই বাসা ভাড়া নেয় তারা। খুব দ্রুত চট্টগ্রামে নাশকতার পরিকল্পনা করছিল তারা। কিছু ডকুমেন্টসও পেয়েছি।
তিনি বলেন, জেএমবি একেবারে দেশ থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান পরিচালনা করছে। তাদের কর্মকান্ড অব্যাহত আছে। হয়ত একসময় যে রকম সুসংগঠিত ছিল, নেতৃত্ব ছিল, সে অবস্থায় এখন নেই। সোনাপাহাড়ের ওই আস্তানায় অন্য যারা ছিল তাদেরও খুঁজে বের করা হবে।

চাকরি করে
জানিয়ে ভাড়া
নেয়া হয় বাসা

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক ঘেঁষে গড়ে তোলা বাড়িটি নির্মিত হয় চার বছর পূর্বে। সে সময় বাড়িটির মালিক ছিল জোরারগঞ্জ ইউনিয়নের ছদরমা দিঘী এলাকার সিরাজুল ইসলাম। সিরাজ তখন ওই বাড়িতে চোরাই তেলের ব্যবসা করতেন বলে স্থানীয়রা জানান। সিরাজুল ইসলামের কাছ থেকে প্রায় এক বছর পূর্বে বাড়িটি কিনে নেন ইছাখালী ইউনিয়নের বাসিন্দা ঠিকাদারী ব্যবসায়ী মাজহার চৌধুরী। পাঁচকক্ষ বিশিষ্ট চৌধুরী ম্যানশনের সেমিপাকা ভবনে সোহেল নামের এক যুবক তার স্ত্রী ও শাশুড়ীকে নিয়ে থাকবে বলে গত ২৮ সেপ্টেম্বর তিনটি কক্ষ পাঁচহাজার টাকায় ভাড়া নেয় এবং নাঈম নামের অপর একজন অপর দুইটি কক্ষ ভাড়া নেয়। ভাড়া নেয়ার সময় তারা বাড়িটি ঘেঁষে অবস্থিত বিএসআএম স্টিল মিল কারখানায় চাকরি করে বলে বাড়ির মালিককে জানায়। অভিযানের সময় বাড়িতে ছিল শুধু দুইজন। তবে বাড়ি ভাড়া দেওয়ার সময় ভাড়াটিয়াদের কাছ থেকে জাতীয় পরিচয়পত্র রাখা হয়নি বলে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে র‌্যাব কর্মকর্তাদের জানিয়েছেন বাড়ির মালিক ও কেয়ারটেকার।

বাড়ির দেয়ালে
দেয়ালে
গুলির চিহ্ন

জেএমবি সদস্যদের আত্মঘাতী বোমার বিস্ফোরণ এতই ভয়াবহ ছিল যে বিস্ফোরণের পর উড়ে যায় বাড়ির টিনের ছাদ, বাড়ির ভেতরের দেয়ালগুলো ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যায়। দেয়ালে দেয়ালে রয়েছে গুলির চিহ্ন, জানালার কাঁচ ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যায়, খুলে পড়ে দরজাগুলো, আসবাবপত্র সবই
ভেঙ্গে খানখান হয়ে যায়, দেখে মনে হবে এ যেন ধ্বংসস্তূপ।

তথ্যসূত্রে- দৈনিক পূর্বদেশ