ক্রিকেটারের জীবন যেন পদ্মপাতায় জল। আর তিনি ইমরুল কায়েস হলে তো আরো টলটলায়মান অবস্থা! আকস্মিক আমিরাতে উড়ে গিয়ে আফগানিস্তানের বিপক্ষে উদ্ধারকারী ৭২ রানের ইনিংস কিংবা জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সেঞ্চুরি— কোনোটাই তাঁর ক্রিকেট ক্যারিয়ারের দীর্ঘমেয়াদি নিশ্চয়তা নয়। এত দিনে ইমরুলেরও বিষয়টি জানা হয়ে যাওয়ার কথা।
তিনি জানেনও। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ডুবন্ত দলকে সেঞ্চুরি দিয়ে উদ্ধার করে ফিরেও তাই সতর্ক ইমরুল, ‘যখনই সুযোগ পাই, শতভাগ দেওয়ার চেষ্টা করি।’ এই ‘যখনই সুযোগ পাই’ কথার মাঝেই প্রকাশ্য যে তিনি দলে অনিয়মিত। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে একমাত্র তিনিই সম্ভবত প্রায় এক দশকেও দলে নিজের জায়গা স্থায়ী করতে পারেননি। ২৮ দিনের ব্যবধানে দুটি গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস খেলা ইমরুলের ভবিষ্যৎও তাই অনিশ্চিত!
এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। এর চেয়েও সুসময় ক্রিকেট ক্যারিয়ারে দেখেছেন ইমরুল কায়েস। ২০১০ সালে তো তামিম ইকবালের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে রান করেছিলেন তিনি। তখন মনে হচ্ছিল উদ্বোধনী জুটির দীর্ঘকালীন সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে চলেছে বাংলাদেশ। কিন্তু পরের বছর শেষ হতেই লম্বা লে-অফে যেতে হয়েছে ইমরুলকে অফ ফর্মের কারণে। ২০১৪ সালে ওয়ানডেতে প্রত্যাবর্তনের পর থেকে ‘এই আছেন এই নেই’ ইমরুল। ব্যাটিং অর্ডারেও ‘সমঝোতা’ করতে হয়েছে তাঁকে, ওপেনিং ছেড়ে মাঝেমধ্যে খেলেছেন তিন নম্বরে। জাতীয় দলের স্কোয়াডে তাঁর অন্তর্ভুক্তিই হয় ব্যাক আপ হিসেবে। তামিম ইকবালের চোট কিংবা অন্য কারো অফ ফর্ম দলে ফিরিয়ে আনে ইমরুলকে। এশিয়া কাপেই যেমন। শুরুর স্কোয়াডে ছিলেন না। কিন্তু আমিরাতের টুর্নামেন্টে তামিমের চোট এবং লিটন দাশ ও নাজমুল হোসেনের অফ ফর্ম সুযোগ করে দেয় ইমরুলকে। আশার কথা সে সুযোগ তিনি লুফেছেন দুহাতে। আফগানিস্তানের বিপক্ষে এশিয়া কাপে দলকে টিকিয়ে রাখা ইনিংসের দুই ম্যাচ পর জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করা ইমরুলকে ২০১৫ বিশ্বকাপের টিকিট পাইয়ে দিয়েছে সম্ভবত।
তবে ম্যাচের নিশ্চয়তা কি দিয়েছে? খুব জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে না। ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজের আগেই পুরো ফিট হয়ে ওঠার কথা তামিম ইকবালের। টিম ম্যানেজমেন্টের বিশ্বকাপ ভাবনায় তিনিই এক নম্বর ওপেনার। তাঁর সঙ্গীর রেসে রয়েছে তিনটি নাম। দুটি প্রভাবশালী ইনিংস খেলে ইমরুল নাম লিখিয়েছেন সে তালিকায়। তবে তাঁর দুই প্রতিদ্বন্দ্বী লিটন দাশ ও সৌম্য সরকার। এ দুজনের প্রতি যে নীতিনির্ধারকদের অনুরাগ রয়েছে, সেটা ইমরুল নিজেও ভালো জানেন। এশিয়া কাপের ফাইনালে করা লিটনের সেঞ্চুরিকে অবলীলায় ‘স্পেশাল’ বলবেন যে কেউ। ২০১৫ বিশ্বকাপে সৌম্য সরকারের প্রতিপক্ষের ওপর প্রাধান্য বিস্তারকারী ইনিংসও ইংল্যান্ড বিশ্বকাপের আগে গুরুত্ব পাবে দল নির্বাচনী সভায়। সঙ্গে এ বাঁহাতির মিডিয়াম পেস বোলিং কিংবা মুশফিকুর রহিমের ব্যাক আপ কিপার হিসেবে লিটনের দক্ষতা—বিবেচনায় আসবে এমন অনেক কিছুই। নয়ত, বিকেএসপিতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচে সৌম্যকে রান পেতে দেখে প্রধান নির্বাচক কেন উৎসাহী হয়ে বলবেন, ‘সহসাই দলে ফিরবে সৌম্য।’ দল নির্বাচনে বরাবর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা বোর্ড সভাপতি নাজমুল হাসানও বলেছেন, ‘পারফরম্যান্স যদি সমান হয় তাহলে একজন জুনিয়র খেলোয়াড়ই বেশি অগ্রাধিকার পাবে।’ ভবিষ্যতের রূপরেখায় এ যুক্তি অসাড়ও নয়। আর এ কারণেই দলের ভেতরেও তিনি ‘দুর্ভাগা’ ক্রিকেটার হিসেবে টুকটাক সমবেদনা পেয়ে থাকেন।
এমন নানা যুক্তিতে বারবার কপাল পুড়েছে ইমরুল কায়েসের। সঙ্গে তাঁর রান পেতে ভুলে যাওয়াও কম দায়ী নয়। ১০ বছরে ৭৪ ম্যাচে তিন সেঞ্চুরি যে কোনো টপ অর্ডার ব্যাটসম্যানেরই আশানুরূপ নয়। ইমরুল নিজেও সন্তুষ্ট নন। তবে তাঁর এ অসন্তুষ্টির পেছনে বাইরের চাপও কিছুটা দায়ী। এই এত দিনেও যে প্রতিটি ইনিংস তিনি ব্যাট করতে নামেন পাহাড়সম চাপ কাঁধে নিয়ে। ২০১০ সালে ক্রাইস্টচার্চে প্রথম সেঞ্চুরি করেছিলেন তিনি। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে সেদিন এমন কিছু না করলে পারলে তখনই ইমরুলের ক্যারিয়ারে যতি টেনে দিতেন তৎকালীন কোচ জেমি সিডন্স। এর ছয় বছর পর কামব্যাক করেছিলেন সেঞ্চুরি দিয়ে। ইমরুলের সবশেষ ওয়ানডে সেঞ্চুরির গায়েও সেঁটে দেওয়া হয়েছে প্রত্যাবর্তনের ছাপ।
সত্যিই কি প্রত্যাবর্তন ঘটে গেছে ইমরুল কায়েসের? ওয়ানডেতে বাংলাদেশের দীর্ঘস্থায়ী ভাবনায় ঢুকে গেছেন তিনি? যদি তা নিশ্চিত ধরে নিয়ে গা এলিয়ে দেন ইমরুল, তবে নিশ্চিতভাবেই আবার প্রত্যাবর্তনের লড়াইয়ে ফিরে যেতে হবে তাঁকে। ইংল্যান্ড বিশ্বকাপে লিটন কিংবা সৌম্যকে ঘিরে লোভ সম্বরণ করা সত্যিই কঠিন যে! শুধু আঁচ করা নয়, ইমরুল বিলক্ষণ জানেন। জানেন বলেই নিজেকে অন্য উচ্চতায় তুলে নেওয়ার নিরন্তর লড়াই-ই তাঁর ক্রিকেটজীবন।