৬ জানুয়ারী জাফর আহমেদ চৌধুরীর মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে লিখিত
জাফর আহমেদ চৌধুরী আমার বাবার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। তারা ছিলেন দুর সম্পর্কের আত্মীয়। সেই সম্পর্কে আমি তাকে আংকেল বলে ডাকতাম। তাকে দেখেছি আমার সেই প্রাইমারী স্কুল জীবনের সময় থেকে।
আমরা থাকতাম তখন চট্টগ্রাম শহরের দেওয়ানহাট পোস্তার পাড় ধনিয়ালাপাড়ায়। বাবার গাড়ির ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও মোটর পার্টস দোকানের দোতলায় ছিল আমাদের বাসাটি। দোকানের পাশ দিয়ে একটি গলি ছিল। সেই গলিতেই থাকতেন জাফর আহমেদ চৌধুরী। বাবার সাথে সন্ধ্যার পর অবসরে দাবা খেলা খেলতেন ও চা খেতেন। আমরা ভাই-বোনেরা সবাই বসে বসে তাদের দাবা খেলা দেখতাম ও শিখতাম। তাদের খেলা দেখে আমিও পরে স্কুল- কলেজের প্রতিযোগীতায় দাবা খেলায় পুরষ্কৃত হয়েছিলাম। একদিন শুনলাম জাফর আহমেদ সাহেব সেই গলি থেকে চলে গেছেন।
তিনি তখন ছোট থেকে বড় ব্যবসায়ী হয়ে ওঠছেন। অবশ্য তার ব্যবসায়িক উত্থান খুব দ্রুত হয়েছিল। কয়েক বছরের মধ্যে তিনি অনেক বড় লোক হয়ে গেছেন খাতুনগঞ্জের ব্যবসা করে। তখন তিনি মাঝে-মধ্যে আমাদের দোকানে আসতেন বাবার সাথে দেখা করতে।
আমাদের দেখে তিনি মাথায় হাত বুলাতেন ও হাসতেন। এক সময় জাফর সাহেবের আসা-যাওয়া একেবারেই কমে গেল। খুব কর্মব্যস্ত দিন কাটে তার। ব্যবসায়ী থেকে শিল্পপতি, এমনকি ব্যাংকের ডাইরেক্টর ও চেয়ারম্যান। বাবার কাছ থেকে শুনেছি জাফর আহমেদ সাহেব খুব শিক্ষিত লোক ছিলেন এবং তিনি ছিলেন মেধাবী ও পরিশ্রমী। তিনি অনেক বড় লোক হয়ে গেলেন।
একসময় তিনি আমাদের ভুলেই গেলেন। ইতিমধ্যে দীর্ঘদিন অসুস্থ থেকে বাবা অকালে মারা গেলেন। আমি তখন কলেজে পড়ছি। লেখাপড়ায় থাকায় বাবা আমাকে তার ব্যবসাতে আনেন নি। তাই তার হঠাৎ মৃত্যুতে কোন কূল- কিনারা পাচ্ছিলাম না। ব্যবসার হাল ধরাও মুশকিল হয়ে ওঠল। দোকানের পুরানো কর্মচারীরা এক প্রকার বেইমানি করল। বিভিন্ন প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়ে আমাকে পথ চলতে হলো।
বাবার আরেক বন্ধু পোস্তার পাড়ের মোহাম্মদ হোসেন সওদাগর আমাকে অনেক সাহায্য – সহযোগীতা করেছিলেন। তিনি আমাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন আমার আমেরিকা যাওয়ার ব্যাপারে জাফর আহমেদ চৌধুরীর সাথে যোগাযোগ করতে। কারণ ইতোমধ্যে আমি ইংরেজি ভাষায় টোফেল করেছি এবং আমেরিকা জর্জিয়া ইউনির্ভাসিটি থেকে এডমিশনের আই টুয়েন্টিও চলে এসেছে। তখন দরকার একজন ভালো গার্জিয়ান বা স্পনসর। জাফর আহমেদ চৌধুরী তখন ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের চেয়ারম্যান। চট্টগ্রামে তিনি বসতেন আগ্রাবাদ তাহের চেম্বারে। খোঁজ নিয়ে গেলাম তার অফিসে। অনেক বছরের ব্যবধান থাকায় তিনি আমার চেহারা দেখে আমাকে চিনতে পারছিলেন না। কিন্তু যখন পরিচয় দিলাম তখন তিনি তার চেয়ার থেকে উঠে গেলেন এবং আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। সেদিন তার সাথে আমি অনেক্ষণ ছিলাম। আমার বিভিন্ন খবর নিলেন। তিনি অনেক দুঃখ প্রকাশ করলেন বাবার মৃত্যুর খবর পান নি বলে।
তিনি নাকি ব্যবসার কাজে প্রায় দেশের বাইরে যাওয়া আসা করতেন। আমি আমেরিকা যাওয়ার আগ্রহের কথা শুনে তিনি খুশি হলেন এবং কিছু পরামর্শ দিলেন। তিনি বললেন আমেরিকা স্টুডেন্ট ভিসা পেতে অনেক সময়ের ব্যাপার আছে । ততোদিন যেন আমি তার অফিসে কাজ করি। ভাবলাম বাবার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ঠিকমতো চালাতে পারছিলাম না। বরং এখানে কাজ করলে হয়তো ব্যবসাটাও শেখা হবে।
আমার আমেরিকা যাওয়ার ব্যাপারে তিনি স্পন্সর হলেন এবং এজন্য তার সমস্ত ব্যাংকিং ও ব্যবসার কাগজপত্র সাপোর্ট দিলেন। আমি আমেরিকান এম্বেসিতে ভিসার জন্য ফেইস করলাম। কিন্তু আমেরিকার সরকারের নতুন নিয়ম আসায় স্টুডেন্ট ভিসা প্রসেসিং এ জটিলতা বেড়ে গেল। তাই আমাকে আরো অনেকদিন অপেক্ষা করতে হলো। সে অনেক কাহিনী। এর পর যতদিন তার কাছে গেছি তিনি কোনদিন আমাকে নিরাশ করেননি।
একসময় দেখলাম তিনি রাজনীতিতে নেমে পড়েছেন। কিন্তু রাজনীতির জটিল সমীকরণে তিনি বারবার ঘুরপাক খাচ্ছেন। তার রাজনীতির হিসাব-নিকাশে কোথায় যেন একটা গ্যাপ ছিল। আমি তার খুলশির বাসায় প্রায় যেতাম। সেখানে দেখতাম কতগুলো রাজনৈতিক টাউট নেতাকর্মী তাকে ঘিরে থাকত।
তিনি যাদেরকে নিয়ে রাজনীতি করার চেষ্টা করতেন তারা আসলে অনেকে কিছু সুবিধা ও টুপাইস পাওয়ার আসায় সেখানে যেত। এসব কথা তাকে বলাতে ঐসব কিছু নেতাকর্মী আমার উপর ক্ষেপা ছিল। আমার সম্পর্কে তাকে ভুল বোঝাত তারা। পরে অবশ্য তিনি তার ভূল বুঝতে পেরেছিলেন। তবে অনেক পরে। যখন সুবিধাবাদীরা একে একে কেটে পড়ে। সে অনেক আগের কথা।
দক্ষিণ চট্টগ্রাম ভিত্তিক একটি পত্রিকা প্রকাশের ইচ্ছে ছিলো তাকে নিয়ে। তবে কেন জানি হয়নি। ইতিমধ্যে আমার জীবনের মোড় অনেক বাক নিয়েছে। কঠিন বাস্তবতার সম্মুখীন হয়ে আমাকে অনেক পথ পাড়ি দিতে হয়েছে।
মিডিয়ায় বেড়ে গেল আমর কর্মব্যস্ততা। মিডিয়ার অফিসিয়াল ট্যুরে গেলাম জাপানে। সেখানে বাংলাদেশের এক অনলাইন পত্রিকায় জানলাম জাফর আহমেদ চৌধুরী গুরুতর অসুস্থ। দেশে ফিরে জানলাম চিকিৎসার জন্য তাকে সিঙ্গাপুর নেওয়া হয়েছে।
এর কয়েকদিন পর শুনলাম তিনি মারা গেছেন। শুনে খুব কষ্ট পেলাম।জীবত অবস্থায় তাকে আর কোনদিন দেখিনি। পত্রিকায় ছাপানো তার ছবি দেখে শ্রদ্ধাবনত হয়ে গেলাম। সেদিন এক অদ্ভূত ঘটনা হলো। যেদিন তিনি মারা গেছেন তার আগের রাতে আমার বাবাকে ঘুমে স্বপ্ন দেখলাম ধনিয়ালাপাড়ার সেই দোকানে, সেই বাসায়। যেখানে তারা দুজনে দাবা খেলতেন । আর কিছুক্ষণ পর পর চা খেতেন। ধুসর স্মৃতিতে চোখে পানি এসে গেলো। আল্লাহ তাদের দুজনকে যেন বেহেস্তে নসিব করেন । আমীন।
সরোয়ার আমিন বাবু ———- লেখক ও সাংবাদিক