বঙ্গোপসাগরে ১১৭ প্রজাতির সামুদ্রিক শৈবাল বা সীউইড সনাক্ত হয়েছে। এর মধ্যে ১০টি রপ্তানিযোগ্য। ছয় বছর ধরে গবেষণার পর কক্সবাজারস্থ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা শহরের নাজিরারটেক, ইনানী, পাটুয়ারটেক ও সেন্টমার্টিন উপকূলসহ শহরতলীর বিভিন্ন নোনা পানির ঘেরে পরীক্ষামূলকভাবে চাষ করে সফলতা পেয়েছেন। এই সফলতার সূত্র ধরে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন স্তরের লোকজনকে সামুদ্রিক এই ‘সবজি’ চাষে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। এসব সামুদ্রিক শৈবালে উচ্চমাত্রায় প্রোটিন, ক্যালসিয়াম ও পটাশিয়ামসহ মানবদেহের জন্য প্রয়োজনীয় ও গুরুত্বপূর্ণ উপাদান রয়েছে। বিজ্ঞানীরা জানান, এসব সবজি হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও আয়োডিনজনিত গলগণ্ড রোগের কার্যকরী প্রতিষেধক হিসেবে বিবেচিত। রক্তে কোলেস্টেরল কমাতেও সীউইডের অনন্য ভূমিকার কথা জানানো হয়।
কক্সবাজারস্থ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্রের উদ্যোগে আয়োজিত ‘উপকূলীয় অঞ্চলে সীউইড চাষ পদ্ধতি’ শীর্ষক তিনদিনের প্রশিক্ষণ কর্মশালায় বিজ্ঞানীরা এসব তথ্য তুলে ধরেন। গত মঙ্গলবার কর্মশালা শেষে প্রশিক্ষণার্থীদের মাঝে সনদ বিতরণ করা হয়। প্রশিক্ষণার্থীদের মধ্যে স্থানীয় জেলে, শিক্ষক, ছাত্র, এনজিও কর্মী, সাংবাদিক ও উদ্যোক্তাসহ ৫০ জন অংশগ্রহণকারী ছিলেন। অনুষ্ঠানে কক্সবাজার মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. জুলফিকার আলী সামুদ্রিক শৈবাল চাষ ও ব্যবহার বিষয়ে তাদের
গবেষণায় অর্জিত সাফল্য তুলে ধরে বলেন, সীউইড সাগরের লোনা জলে নিমজ্জিত এক প্রকার উদ্ভিদ, যা বিশ্বব্যাপী একটি গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক জলজ সম্পদ হিসেবে বিবেচিত। পুষ্টিমানের বিচারে বিভিন্ন দেশে খাদ্য ও শিল্পের কাঁচামাল হিসেবেও এটি সমাদৃত। মানব খাদ্য হিসেবে ব্যবহার ছাড়াও ডেইরি, ঔষধ, টেক্সটাইল ও কাগজ শিল্পে সী-উইড আগার কিংবা জেল জাতীয় দ্রব্য তৈরিতে কাঁচামাল হিসেবে বহুল ব্যবহৃত হয়। তাছাড়া জমিতে সার হিসেবে, প্রাণী খাদ্য ও লবণ উৎপাদনেও সীউইড ব্যবহার করা হয়। সীউইডে প্রচুর পরিমাণে খনিজ দ্রব্য থাকায় খাদ্যে অণুপুষ্টি হিসেবে এর ব্যবহার গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে বলে জানান তিনি।
তিনি আরো জানান, আমাদের দেশে খাবার হিসেবে এর জনপ্রিয়তা না থাকলেও বিদেশে প্রচুর চাহিদা ও বাজার মূল্য রয়েছে। এসব পণ্য বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব।
কর্মশালায় সামুদ্রিক শৈবাল চাষ বিষয়ে আরো আলোচনা করেন কেন্দ্রের সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শফিকুর রহমান, আশরাফুল হক, বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা জাকিয়া হাসান, আহমেদ ফজলে রাব্বী, মোজাম্মেল হক, মহিবুল ইসলাম ও প্রকল্প পরিচালক শাহনূর জাহেদুল হাসান।
কর্মশালায় বিজ্ঞানীরা গবেষণালব্ধ ফলাফল তুলে ধরে জানান, বঙ্গোপসাগরের উপকূলে কক্সবাজার জেলার টেকনাফ সেন্টমার্টিন দ্বীপ, ইনানী ও শহরতলীর বাঁকখালী মোহনার আশপাশের পাথুরে ও প্যারাবন এলাকায় জোয়ার-ভাটার অন্তর্বর্তী স্থানেই অধিকাংশ সীউইড জন্মায়। তবে সীউইড জন্মানোর জন্য কিছু ভিত্তির প্রয়োজন পড়ে। সাধারণত বড় পাথর, প্রবাল, শামুক-ঝিনুক-পলিকিটের খোসা, প্যারাবনের গাছ ও শিকড়, শক্ত মাটি কিংবা অন্য যেকোনো শক্ত বস্তুর উপর সীউইড জন্মে।
কক্সবাজার ও পার্বত্য অঞ্চলের রাখাইন ও অন্যান্য উপজাতীয় জনগোষ্ঠী সালাদ ও চাটনি হিসেবে সীউইড ব্যবহার করে। তবে অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায় এখনো খাদ্য হিসাবে ব্যবহার শুরু করেনি। প্রাথমিকভাবে বিস্কুট, স্যুপ ও চিপসের সাথে সীউইড ব্যবহার শুরু করার প্রস্তাব দেন বিজ্ঞানীরা।
স্থানীয় ভাষায় সীউইড ‘হেজালা’ নামে পরিচিত। বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের কক্সবাজার সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্র ২০১৩ সাল থেকে সীউইড নিয়ে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। ইনস্টিটিউট থেকে কক্সবাজার সদর উপজেলার বাঁকখালী নদী, মহেশখালী চ্যানেলের মোহনায় নুনিয়ারছড়া থেকে নাজিরারটেক পর্যন্ত সৈকত সংলগ্ন জোয়ার-ভাটা এলাকা ও মহেশখালী দ্বীপের বিভিন্ন এলাকায় বাণিজ্যিক গুরুত্ব সমপন্ন সীউইডের প্রাকৃতিক উৎপাদন ক্ষেত্রের সন্ধান লাভ করেছে। প্রাপ্যতা ও স্থানীয় পরিবেশের সাথে মানানসই প্রজাতিগুলোর পুষ্টিমান যাচাই এবং খাদ্য উপাদান হিসেবে বাণিজ্যিক গুরুত্বের আলোকে গবেষণা পরিচালনা করা হয়েছে।
ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীরা কক্সবাজার উপকূলে এ পর্যন্ত ১১৭ প্রজাতির সীউইড সনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন। সেই সাথে সীউইডের পুষ্টিমাণ নির্ণয় করা হয়েছে। এর মধ্যে ১০ প্রজাতির সীউইড বাণিজ্যিক গুরুত্ব সমপন্ন। এর মধ্যে Hypnea musciformas (সাগর সেমাই), Enteromorpha intestinalis (সাগর পাতা), Caularpa racemosa (সাগর আঙুর), Sargassum oligocystum (সাগর ঘাস), Padina tetrastromatica (সাগর ঝুমকা), Hydroclathrus clathratus (জিলাপি শেওলা), Catenella spp. (শৈবাল মূললতা) এবং Ges Porphyra spp. (লাল পাতা) অন্যতম বলে জানান কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা।
বিজ্ঞানীরা আরো জানান, আমাদের জলবায়ুতে স্থানভেদে নভেম্বর থেকে মে মাস পর্যন্ত প্রায় ৬ মাস সীউইড চাষ করা যায়। তবে চাষের সর্বোচ্চ অনুকূল অবস্থা বিদ্যমান থাকে জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত। নারকেলের রশি ও নাইলনের মাছ ধরার জাল ব্যবহার করে ইনস্টিটিউট থেকে আনুভূমিক নেট পদ্ধতিতে সীউইড চাষ প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে। এ পদ্ধতিতে ৩ প্রজাতির (সাগর সেমাই, সাগর পাতা ও সাগর আঙুর) শৈবাল চাষ প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে। উপকূলে হিপনিয়া প্রজাতির সামুদ্রিক শৈবালের উৎপাদনশীলতা (৩০ কেজি/বর্গমিটার) পার্শ্ববর্তী দেশের একই প্রজাতির উৎপাদনশীলতার সাথে সামঞ্জ্যপূর্ণ।
গবেষণায় দেখা গেছে, উপকূলের লেগুন বা আশ্রয়যুক্ত স্থান, যা সাগরের প্রবল ঢেউ ও স্রোতের প্রভাবমুক্ত, দূষণমুক্ত পানি এবং জনউপদ্রব কম এমন জায়গা শৈবাল চাষের জন্য উপযুক্ত। সাগর সেমাই, সাগর পাতা ও সাগর আঙুর চাষের জন্য কক্সবাজার জেলার সমুদ্র উপকূলবর্তী সেন্টমার্টিন, বাঁকখালী ও ইনানী এলাকার জোয়ার-ভাটার মধ্যবর্তী স্থান নির্বাচন করা হয়। নির্বাচিত স্থানগুলোর মধ্যে সেন্টমার্টিন দ্বীপের পানির তলদেশ বালুকাময়, পাথুরে ও প্রবাল দ্বারা আবৃত, বাঁকখালীর পানির তলদেশ কাদা ও বালিযুক্ত এবং ইনানীর পানির তলদেশ বালুকাময়, শিলা পাথর, খোলস চূর্ণ ও নুড়ি পাথরযুক্ত।
ইনস্টিটিউটের সামুদ্রিক মৎস্য ও প্রযুক্তি কেন্দ্র, কক্সবাজারের সামুদ্রিক শৈবাল গবেষক দল কক্সবাজার জেলার সমুদ্র উপকূলবর্তী সেন্টমার্টিন, বাঁকখালী ও ইনানী এলাকার জোয়ার-ভাটার অন্তর্বর্তী স্থানে আনুভূমিক জাল পদ্ধতি (২০ সেন্টিমিটার ফাঁসযুক্ত নারকেলের ছোবড়ার রশি দিয়ে জাল (৪ মিটার গুণ ৪ মিটার) ব্যবহার করে সামুদ্রিক শৈবাল সাগর আঙুর ও সাগর সেমাই চাষ অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক বলে গবেষণায় দেখা গেছে।
কক্সবাজার উপকূলে প্রাপ্য সীউইড থেকে ১০টি প্রজাতির সাধারণ পুষ্টিমান ও মাইক্রোনিউট্রিয়েন্টের পরিমাণ নির্ণয় করা হয়েছে বলে জানান বিজ্ঞানীরা। তারা আরো জানান, নির্বাচিত সীউইডের প্রত্যেকটিই প্রচুর পরিমাণে অণুপুষ্টি সমপন্ন এবং প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম, পটাসিয়াম ও লৌহ বিদ্যমান, যা আমাদের উপকূলীয় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর পুষ্টি চাহিদা পূরণে ভূমিকা রাখতে পারে।
বিজ্ঞানীরা জানান, সীউইডের প্রোডাক্ট তৈরির জন্য তিনটি প্রজাতি Hypnea sp, C. racemosa, S. crassifolium ব্যবহার করা যায়। সামুদ্রিক আঙুর ভালোভাবে পরিষ্কার করে তাজা অবস্থায় সালাদ হিসেবে খাওয়া যায়। স্থানীয় উপজাতি সম্প্রদায় খাদ্যকে সীউইড সমৃদ্ধ করার জন্য হিপনিয়া প্রজাতিটি ব্যবহার করে থাকে। যেকোনো খাদ্যে অন্যান্য উপাদানের সাথে অল্প পরিমাণ হিপনিয়ার পাউডার বা সিদ্ধ করা তরল ব্যবহার করে খাদ্যমান বৃদ্ধি করা সম্ভব। চাষকৃত সামুদ্রিক শৈবালের খাদ্য আইটেমগুলো সালাদ, স্যুপ, আচার, পিঠা, চানাচুর, জেলি, সস হিসেবে বেশি ব্যবহৃত হয়। সীউইড চাষ প্রযুক্তি ও এর ব্যবহার পদ্ধতিগুলো সমপ্রসারণ করা গেলে দেশের উপকূলীয় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নের পাশাপাশি খাদ্য ও ঔষধ শিল্পে এর ব্যাপক ব্যবহার সম্ভব হবে। এ বিষয়ে বর্তমানে গবেষণষা কার্যক্রম চলমান রয়েছে বলে জানান বিজ্ঞানীরা।
সামুদ্রিক শৈবাল চাষ প্রযুক্তি আমাদের দেশে সামুদ্রিক সমপদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে একটি নতুন উদ্যোগ। এর চাষ প্রযুক্তি সমপ্রসারণের মাধ্যমে উপকূলীয় জলাশয় চাষের আওতায় এনে দরিদ্র জনসাধারণের বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে সরকার। দেশের বিপুল জনগোষ্ঠীর পুষ্টির চাহিদা পূরণে সীউইড খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলা প্রয়োজন বলে মতামত দেন বিজ্ঞানীরা।
তারা জানান, অধিকাংশ সামুদ্রিক সবজিতে সামুদ্রিক লবণের চেয়ে অধিক পরিমাণে আয়োডিন রয়েছে বলে গলগণ্ড রোগের প্রতিষেধক হিসেবে এটি কাজ করে। বাংলাদেশের ৭১০ কিলোমিটারব্যাপী সমুদ্র সৈকত এবং ২৫ হাজার বর্গকিলোমিটারব্যাপী উপকূূলীয় অঞ্চলে পরিকল্পিত পদ্ধতিতে বাণিজ্যিকভাবে সামুদ্রিক শৈবাল চাষ অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। সামুদ্রিক মাছ ও কাঁকড়ার পাশাপাশি চাষ ও রপ্তানি করে বাংলাদেশের ব্লু-ইকোনমি জোরদার করা যেতে পারে।