রোজার আগে সাতকানিয়ায় ইফতারের সামগ্রী নিতে গিয়ে নয়জনের মৃত্যুর জন্য আয়োজনকারী ও পুলিশ ‘হিট স্ট্রোক’কে কারণ দেখাতে চাইলেও ভিন্ন কথা বলছেন প্রশাসনিক কর্মকর্তা ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা।
তারা ইফতার সামগ্রী বিতরণকারীদের অব্যবস্থাপনার দিকে ইঙ্গিত করে বলেছেন, এই কারণে অতিরিক্ত ভিড়ে পদদলিত হয়ে এতজনের প্রাণহানি ঘটেছে।
আহত যে একজন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন, তাকে পরীক্ষা করে ‘হিট স্ট্রোকের’ কোনো প্রমাণ না পাওয়ার কথা জানিয়েছেন সেখানকার চিকিৎসকরা।
শনিবার সকালে চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার নলুয়া ইউনিয়নের পূর্ব গাটিয়াডেঙ্গা (হাঙ্গরমুখ) এলাকার কাদেরীয়া মুঈনুল উলুম দাখিল মাদ্রাসা মাঠে ইফতার সামগ্রী বিতরণের সময় ভিড়ের চাপে নয় নারীর মৃত্যু ঘটে।
কবির স্টিল রি রোলিং মিল (কেএসআরএম) নামের ইস্পাত কারখানার মালিকের পক্ষে ওই মাদ্রাসা মাঠে প্রতিবছরের মতো এবারও ইফতার সামগ্রি ও নগদ টাকা বিতরণ করা হচ্ছিল।
নয়জনের মৃত্যুর পর ইফতার সামগ্রী বিতরণ বন্ধ করে দেয় পুলিশ ও উপজেলা প্রশাসন।
এই ঘটনায় মোট ২০ জন আহত হন। তাদের মধ্যে মোস্তফা বেগমকে (৬০) সোমবার বিকেলে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
হতাহতদের নিয়ে হাসপাতাল পানে অ্যাম্বুলেন্স হতাহতদের নিয়ে হাসপাতাল পানে অ্যাম্বুলেন্স
মোস্তফা নলুয়া গ্রামের বাসিন্দা এবং বাক প্রতিবন্ধী। তার মেয়ে আমেনা বেগম বলেন, তার মা প্রতিবছরই সেখানে ইফতার সামগ্রী সংগ্রহে যান।
“আজও গিয়েছিলেন। সকাল ১০টার দিকে আমি খবর পাই। তারপর অনেক কষ্টে উনাকে খুঁজে নিয়ে হাসপাতালে যাই।”
তার অসুস্থতার কারণ জানতে চাইলে হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক ডা. আমিনুল হক সরকার বলেন, “তার মাথায় আঘাত লেগেছে। হিট স্ট্রোক বা সেরকম কিছু নয়।”
ঘটনার পরপরই চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার নূরে আলম মিনা বলেছিলেন, “ভিড়ের মধ্যে অতিরিক্ত গরমে হিট স্ট্রোকে মানুষের মৃত্যু হয়েছে।”
একই কথা বলেছিলেন জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার দক্ষিণ এমরান ভুঁইয়াও।
সোমবার বিকালে ঘটনাস্থলে গণমাধ্যমকর্মীরা গেলে স্থানীয় কিছু যুবক হতাহতদের স্বজনদের দিয়ে ‘হিট স্ট্রোকে’ মৃত্যু হয়েছে বলানোর চেষ্টা করছিলেন।
ওই যুবকদের মধ্যে কলিমউল্লাহ ও শাহজাহান নামের দুজনের নাম জানা গেছে। তারা কেএসআরএম-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শাহজাহানের দানশীলতার কথা সাংবাদিকদের কাছে বলছিলেন।
কাদেরীয়া মুঈনুল উলুম দাখিল মাদ্রাসা মাদ্রাসার পাশেই কেএসআরএম-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পৈত্রিক বাড়ি। মাদ্রাসাটি তাদের অর্থায়নে প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত হয়।
রাতে চট্টগ্রাম নগরীতে এক সংবাদ সম্মেলনে কেএসআরএম-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মেহেরুল করিমও হিট স্ট্রোককে মৃত্যুর কারণ হিসাবে দেখান।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “আমার জানা মতে হিট স্ট্রোক মৃত্যুর মূল কারণ। তবে তার মধ্যে কিছুটা হুড়োহুড়িরও ঘটনা ঘটেছে।”
আহাজারি থামছে না মৃতদের স্বজনের আহাজারি থামছে না মৃতদের স্বজনের
নলুয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান তাসলিমা আক্তার বলেন, ঘটনার খবর পেয়ে বেলা ১০টার পরপর সেখানে গিয়ে মাঠে লাশ পড়ে থাকতে দেখেন তিনি।
তিনি বলেন, “অতিরিক্ত গরম এবং ধাক্কাধাক্কিতে এ ঘটনা ঘটতে পারে বলে আমার মনে হচ্ছে।”
পূর্ব নলুয়ার গ্রাম পুলিশ মোবারক আলী বলেন, “ইফতার সামগ্রী বিতরণের সময় মানুষের চাপ সৃষ্টি হয়ে ধাক্কাধাক্কি শুরু হলে এক পর্যায়ে লোকজন মাটিতে পড়ে যায়।”
সাতকানিয়ার ইউএনও মোবারক হোসেন বলেন, “প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যে পদদলন, সাফোকেশন এবং ধাক্কাধাক্কির কারণে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে।”
পুলিশ কর্মকর্তা এমরান ভুঁইয়া বিকেলে জিজ্ঞাসায় বলেন, “কীভাবে মৃত্যু হয়েছে, তা এখনও আমরা নিশ্চিত নই। মৃত্যুর নানা কারণ থাকতে হবে।”
হিট স্ট্রোকের বিষয়ে তিনি বলেন, “প্রত্যক্ষদর্শীরা আমাদের বলেছে হঠাৎ একজন একজন করে লাইন থেকে পড়ে যায়। দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়ানোর কারণে অসুস্থ হয়ে পড়েও যেতে পারে। তদন্ত করে দেখা হবে আসলে কী হয়েছে।”
ভিড় সরে গেলে পড়ে থাকে মানুষের জুতা ভিড় সরে গেলে পড়ে থাকে মানুষের জুতা
২০০৫ সালের অক্টোবরে সাতকানিয়ায় এই কেএসআরএম মালিকের জাকাত নিতে এসেই পদদলনে আটজনের মৃত্যু হয়েছিল।
এবারও আয়োজনের অব্যবস্থাপনায় ত্রুটির দিকে ইঙ্গিত করে ইউপি চেয়ারম্যান তাসলিমা বলেন, “যে মাঠে আয়োজন করা হয়েছে, সেখানে ১০ হাজারের মতো লোক থাকতে পারে। কিন্তু সমবেত হয় ২০ হাজারেরও বেশি মানুষ।”
গ্রাম পুলিশ মোবারক আলী বলেন, “যত মানুষের আয়োজন তার চেয়ে বেশি ভিড় ছিল। আগতরা সবাই মহিলা। নলুয়া থেকে শুধু নয় আশেপাশের অনেক এলাকা থেকে চলে আসে।”
সাতকানিয়ার ইউএনও মোবারক বলেন, “অবশ্যই অব্যবস্থাপনা ছিল। যত আয়োজন ছিল, তার থেকে অনেক বেশি লোক এখানে এসেছে। যত লোক ছিল, সে তুলনায় স্বেচ্ছাসেবক ছিল না।”
এ ধরনের আয়োজনের জন্য উপজেলা বা জেলা প্রশাসনকে জানানো হয়নি বলে জানান তিনি।
তবে কেএসআরএম-এর সিইও মেহেরুল করিমের দাবি, তাদের ১০০ জন নিজস্ব নিরাপত্তা কর্মী এবং ৭০-৮০ জন পুলিশ সদস্য দায়িত্ব পালন করছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনে কেএসআরএম-এর সিইও মেহেরুল করিম সংবাদ সম্মেলনে কেএসআরএম-এর সিইও মেহেরুল করিম
তিনি বলেন, “আমরা স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশকে আগেই জানিয়ে রেখেছিলাম। পুলিশ এসেছিল, আমাদের নিজস্ব সিকিউরিটির ১০০ জনের বেশি লোক ছিল। একটা মেডিকেল টিমও রাখা হয়েছিল মাঠের পাশে।”
ইউএনও মোবারক বলেন, “আসলেই কী কারণে দুর্ঘটনা ঘটেছে, সেটা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে গঠিত তদন্ত কমিটি দেখবে।”
মৃত্যুর ঘটনা তদন্তে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে জেলা প্রশাসন। অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ মাশহুদুল কবীরের নেতৃত্বে গঠিত এই কমিটিকে সাত কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।
আটজনের লাশ তাদের স্বজনরা প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে ময়নাতদন্ত ছাড়াই নিয়ে গেছে বলে ইউএনও জানান।
কেএসআরএম কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, মারা যাওয়া প্রত্যেকের পরিবারকে তিন লাখ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেবেন তারা। আহতদের চিকিৎসার ব্যয়ভার কোম্পানির পক্ষ থেকেই বহন করা হবে।
পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের কেউ যদি কেএসআরএম-এ চাকরি করতে চান, সে ব্যবস্থাও করার আশ্বাস দেন কোম্পানির সিইও মেহেরুল।