শুরুতেই বড় জয় বাংলাদেশের।

দুবাইয়ের ঝলমলে আকাশে হঠাৎ কালো মেঘ। ম্যাচ শুরু হতে না হতেই নেই হয়ে গেলেন দুই ব্যাটসম্যান; লিটন আর সাকিব। দ্বিতীয় ওভার শেষে হাতের কব্জিতে ব্যথা পেয়ে মাঠ ছাড়লেন তামিম ইকবালও। দুই ওভারে মাত্র ২ রানে তিন টপ অর্ডার ব্যাটসম্যানকে হারিয়ে সেই মেঘ থেকে বৃষ্টি ঝড়ার অপেক্ষা। সেই মেঘকে দূরে ঠেলে দিয়ে আকাশে আবার সূর্যের ছবি আঁকতে মাঠে এলেন বাংলাদেশ দলের ভরসার অন্যতম নাম মুশফিক। আরো একবার নিজেকে প্রমাণ করে এশিয়া কাপের প্রথম ম্যাচেই বাংলাদেশকে বড় জয় এনে দিতে রাখলেন দারুণ ভূমিকা। নবাগত মিঠুনকে নিয়ে ধীরস্থির শুরু, এরপর আস্তে আস্তে নিজের ইনিংস আর রান রেটকে বড় করার চ্যালেঞ্জ। দলের সবশেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে ৪৯.৩ ওভারে আউট হওয়ার সময় মুশফিকের নামের শেষে ১৪৪ রানের উজ্জ্বল ইনিংস। ক্যারিয়ার সেরা ইনিংসের পাশাপাশি তুলে নিলেন ওডিআইতে নিজের ষষ্ঠ সেঞ্চুরিও। একেবারে শেষ মুহূর্তে ইনজুরিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে তামিম ইকবালের মাঠে নামা আর একহাতে ব্যাট করার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত বাংলাদেশ দলের সব আশা–ভরসাই হয়ে থাকলেন মুশফিক। ম্যাচ শেষে তাই ম্যাচ সেরার পুরস্কারটাও ওঠল তার হাতে। সাথে দর্শকদের ভালোবাসাটা আদায় করে নিলেন তামিমই।

মুশফিকের এমন ইনিংসের পর বোলারদের নিয়ন্ত্রিত বোলিংয়ে শ্রীলঙ্কাকে ১৩৭ রানের বড় ব্যবধানে হারিয়ে এশিয়া কাপে শুভসূচনা করল বাংলাদেশ। এই জয় দেশের বাইরে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জয়। বাইরে আগের সবচেয়ে বড় জয় ছিল ২০১৩ সালে জিম্বাবুয়েতে ১২১ রানের জয়। ঘরে–বাইরে মিলিয়েও বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জয় শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে। গত জানুয়ারিতে মিরপুরে ১৬৩ রানে জিতেছিল বাংলাদেশ। ১২৪ রানে অলআউট বাংলাদেশের বিপক্ষে শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে কম রানে আউট হওয়ার রেকর্ড। আগের সর্বনিম্ন ইনিংস ছিল ২০০৯ সালে ১৪৭।

ব্যাট করতে নেমে শ্রীলংকার হয়ে শুরু থেকেই ঝড় তুলেছেন উপুল থারাঙ্গা। তবে আরেক পাশে কুসল মেন্ডিসকে ফিরিয়ে বাংলাদেশকে প্রথম উইকেট এনে দিলেন মুস্তাফিজ। এলবিডব্লিউয়ের আবেদনে সাড়া দেননি আম্পায়ার ইরাসমাস। রিভিউ নেয় বাংলাদেশ। মূল প্রশ্ন ছিল বল লাইনে পিচ করেছে কিনা। সেটি ছিল ঠিক। রিভিউ পক্ষে আসে বাংলাদেশের। মেন্ডিস আউট হলেন তার খেলা প্রথম বলেই। ইনিসের দ্বিতীয় বলেই মাশরাফিকে ছক্কা। চতুর্থ বলে চার। পরের ওভারে মুস্তাফিজকে দুটি চার। উপুল থারাঙ্গা শুরু করেছিলেন ঝড়ের বেগে। সেই ঝড় থামিয়ে মাশরাফি নিলেন মধুর প্রতিশোধ। জায়গা বানিয়ে খেলতে পছন্দ করেন থারাঙ্গা। সেই জায়গাই দেননি মাশরাফি। ভেতরে ঢোকা বল থার্ডম্যানে পাঠাতে গিয়ে থারাঙ্গা টেনে আনলেন স্টাম্পে। ১৬ বলে ২৭ রানে বোল্ড থারাঙ্গা।

থারাঙ্গার পর শ্রীলঙ্কার মিডল অর্ডারের অন্যতম ভরসা ধনাঞ্জয়া ডি সিলভাকেও ফেরালেন মাশরাফি। অফ স্টাম্পে পিচ করে হালকা ভেতরে ঢোকা বল ঠিকমতো খেলতে পারেননি ধনাঞ্জয়া। আবেদনের সঙ্গে সঙ্গেই আঙুল তোলেন আম্পায়ার। শ্রীলঙ্কা রিভিউ নিয়েছিল। তাতে কাজ হয়নি। উইকেটের পাশাপাশি হারাতে হয়েছে রিভিউটিও। শূন্য রানে ফিরলেন ধনাঞ্জয়া। মেহেদী হাসান মিরাজের বল শুরু থেকেই ঠিকমতো খেলতে পারছিলেন না কুসল পেরেরা। শেষ পর্যন্ত বিপজ্জনক বাঁহাতি ব্যাটসম্যানকে বিদায় করেই দিলেন মিরাজ। স্টাম্পের একটু দূর থেকে করা বলে মিরাজ পরাস্ত করলেন কুসলকে। বল লাগল পায়ে। আম্পায়ারের আঙুল উঠতে সময় লাগেনি। এমনিতে আক্রমণাত্মক পেরেরা এদিন করেছেন ২৪ বলে ১১।

ক্যাচ দিয়ে বেঁচে গেলেও রান আউট থেকে বাঁচতে পারলেন না দাসুন শানাকা। পানি বিরতির পর প্রথম বলেই বাংলাদেশ তুলে নিল আরও একটি উইকেট। মিরাজের বল লেগ সাইডে ঠেলে রানের জন্য ছুটছিলেন ম্যাথিউস। তখন ছুটতে শুরু করেন শানাকাও। কিন্তু থমকে যান ম্যাথিউস। সময়মতো ফিরতে পারেননি শানাকা। সাকিবের থ্রো ধরে বেলস ফেলেছেন বোলার মিরাজ। ৭ রানে ফিরলেন শানাকা।

উইকেট উৎসবে যোগ দিলেন রুবেল হোসেন। নিজের প্রথম ওভারেই ফিরিয়ে দিলেন অ্যাঞ্জেলো ম্যাথিউসকে। লেংথ থেকে অ্যাঙ্গেলে একটু ভেতরে ঢোকা বলে এলবিডব্লিউ। ধারাভাষ্যকক্ষে কুমার সাঙ্গাকারা বললেন, শ্রীলঙ্কার শেষ আশাও হয়ত শেষ হয়ে গেল। ম্যাথিউস আউট হলেন ১৬ রানে। মিরাজের স্কিড করা বল ঠিকমতো খেলতে পারেননি থিসারা পেরেরা। বোলারের মনে হলো বল লেগেছিল প্যাডে। আম্পায়ার আবেদনে সাড়া না দিলে রিভিউ নিল বাংলাদেশ। রিপ্লেতে দেখা গেল, বল প্যাডে লাগেইনি। লেগেছে ব্যাটে। বাংলাদেশ হারাল রিভিউ। তবে পরের বলেই থিসারা পেরেরা নিজেই উইকেট উপহার দিলেন। মিরাজকে উড়িয়ে মারতে গিয়ে ধরা পড়লেন পয়েন্টে রুবেলের হাতে। বাংলাদেশকে অনেকবার ভোগানো বিপজ্জনক থিসারার বিদায় ৬ রানেই।

লোয়ার অর্ডারে একটি প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করেছিলেন সুরাঙ্গা লাকমল। জুটি গড়ার চেষ্টা করেছিলেন দিলরুয়ান পেরেরাকে নিয়ে। সেই চেষ্টার ইতি টানলেন মুস্তাফিজ। অফ কাটারে বোল্ড করে দিলেন লাকমলকে। লাকমল বিদায় নিলেন ২০ রানে। ভাঙল ২৭ রানের জুটি, ইনিংসের যা সর্বোচ্চ। বলে হাত ঘোরালেন মোসাদ্দেকও। ধরলেন শিকার। ফিরিয়ে দিলেন একপ্রান্ত আগলে রেখে লড়াই করতে থাকা দিলরুয়ান পেরেরাকে। ওভারের প্রথম বলে বেরিয়ে এসে মোসাদ্দেককে খেলতে চেয়েছিলেন দিলরুয়ান। বুদ্ধিদীপ্ত বোলিংয়ে করতে পারেননি ব্যাটে–বলে। বাকি কাজ সেরেছেন কিপার লিটন দাস, স্টাম্পড। ইনিংসের সর্বোচ্চ ২৯ রান করে ফিরলেন দিলরুয়ান।

বাকিদের উইকেট শিকারের মেলায় বাকি ছিলেন কেবল সাকিব আল হাসান। শেষ উইকেট তুলে নিয়ে তিনিও সামিল হলেন। ফিরিয়ে দিলেন আমিলা আপোন্সোকে। ৩৫.২ ওভারেই শ্রীলঙ্কা গুটিয়ে গেল মাত্র ১২৪ রানে। বাংলাদেশের জয় ১৩৭ রানে।

ম্যাচের শুরুতে টসে জিতে ব্যাট করতে নামা বাংলাদেশ বড় ধাক্কা খায়। প্রথম ওভারেই বিপর্যয়ে পড়ে টাইগাররা। কারণ সে ওভারেই যে মালিঙ্গা ফিরিয়ে দিয়েছেন লিটন এবং সাকিবকে। ১ ওভারে ১ রানে নেই ২ উইকেট। এরপর মার উপর খড়ার ঘায়ের মত আরো বড় ধাক্কা খেল বাংলাদেশ তামিমকে হারিয়ে। না তিনি আউট হননি। কিন্তু মাঠ থেকে বেরিয়ে যেতে হয়েছে। ইনিংসের দ্বিতীয় ওভারে আর সুরঙ্গা লাকমালের করা প্রথম ওভারের শেষ বলে তামিম ব্যাথা পান হাতে। বের হয়ে যেতে হয় মাঠ থেকে। বাংলাদেশ দল তখন মহাবিপদে। বলতে গেলে ৩ রানে ৩ উইকেট নাই তখন। এমন কঠিন পরিস্থিতিতে মিথুনকে নিয়ে ঘুরে দাড়ানোর চেষ্টা করলেন মুশফিক। দারুনভাবে ঘুরেও দাড়িয়েছিলেন দুজন। তৃতীয় উইকেটে ১৩১ রানের বড় জুটি গড়ে দলকে খাদের কিনারা থেকে উদ্ধার করেন এই যুগল। তাদের জুটির উপর ভর করেই বড় সংগ্রহ গড়ার স্বপ্ন দেখছিল টাইগাররা।

কিন্তু আবার সেই মালিঙ্গার আঘাত। দ্বিতীয় স্পেলে বল করতে এসে প্রথম ওভারেই ভাঙলেন এ জুটি। ফেরালেন মিথুনকে। ৬৮ সবলে ৬৩ রান করা মিথুন ফিরলেন উইকেট রক্ষকের হাতে ক্যাচ দিয়ে। এই জুটিটি ভাঙার পর আবার সে বিপর্যয়। মাহমুদউল্লাহ আর মোসাদ্দেক হোসেন বিরিয়ে দিয়ে এলেন নিজেদের উইকেট। এরপর মুশফিক লড়ে গেলেন একাই। মেহেদী হাসান মিরাজ আর মাশরাফি বিন মর্তুজা একটু চেষ্টা করেছিলেন তাকে সঙ্গ দেওয়ার। কিন্তু পারেননি তারা। মিরাজ ১৫ আর মাশরাফি ১১ রান করে সাজঘরে ফিরেন।

মুশফিক একটা প্রান্ত ধরে লড়েছেন বীরের মতো। সতীর্থদের আসা যাওয়ার মাঝেও দাঁতে দাঁত চেপে এগিয়ে গেছেন বাংলাদেশ দলের এই ব্যাটিং ভরসা। তুলে নিয়েছেন দুর্দান্ত এক সেঞ্চুরি। যেটি তার ক্যারিয়ারের ষষ্ঠ ওয়ানডে শতক। নবম উইকেটে মোস্তাফিজুর রহমানকে নিয়ে ২৬ রানের একটি জুটি গড়েন মুশফিক। ১০ রান করে মোস্তাফিজ রানআউট হয়ে ফিরে গেলে সবাইকে অবাক করে দিয়ে মাঠে নেমে যান তামিম ইকবাল। ওভারের শেষ বলটি এক হাতেই ঠেকিয়ে দেন তিনি। এরপর মুশফিক যেন নতুন করে সঞ্জিবনী শক্তি পেলেন। যে শক্তি বদৌলতে নতুন করে জেগে উঠলেন। খেললেন অবিশ্বাস্য এক ইনিংস। শেষ ওভারের তিন বল বাকি থাকতে যখন ফিরেন মুশফিক তখন তার নামের পাশে জ্বল জ্বল করছিল ১৪৪ রানের অনবদ্য এক ইনিংস। ১৫০ বলে ১১ বাউন্ডারি আর ৪ ছক্কায় গড়া তার ইনিংসটা ক্যারিয়ারসেরা। আগের সেরাটি ছিল ১১৭। আর বাংলাদেশের কোনো ব্যাটসম্যানের ওয়ানডেতে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ইনিংস এটি। তার এমন বীরত্বপূর্ণ ইনিংসে ভর করে শেষপর্যন্ত ২৬১ রানে অলআউট হয় টাইগাররা। লঙ্কানদের পক্ষে সবচেয়ে সফল বোলার লাসিথ মালিঙ্গা। দীর্ঘ এক বছর পর ওয়ানডে দলে ফেরা এই পেসার ২৩ রানে নেন ৪টি উইকেট।

তথ্যসূত্রে- দৈনিক আজাদী