১৯৫২ থেকে ১৯৭১ ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ। বাঙালি জাতির অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায় লুকিয়ে আছে এ সময়কালে। বিভিন্ন আন্দোলন–সংগ্রামের মাধ্যমে নানা ষড়যন্ত্র উৎখাত করে আজকের বাংলাদেশ নির্মাণের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ধাপ অর্জিত হয়েছে ওই সময়ে। স্বর্ণালী সেই সময়কে ম্যুরাল চিত্রের মাধ্যমে এবার চট্টগ্রামবাসীর সামনে তুলে ধরার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। ঐতিহাসিক লালদীঘি মাঠের সীমানা দেয়ালে টাইলসের মাধ্যমে এ মুর্যাল চিত্র নির্মাণ করবে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন ও স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র দৈনিক আজাদী। ‘গৌরবের ইতিহাস’ শিরোনামে এ ম্যুরাল নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছেন সিটি কর্পোরেশনের আন্দরকিল্লা ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জহর লাল হাজারী।
ম্যুরাল নির্মাণে গৃহীত ‘গৌরবের ইতিহাস’ প্রকল্পে ব্যয় হবে ৪২ লাখ টাকা। এতে দৈনিক আজাদী ২০ লাখ টাকা এবং চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন থেকে বাকি অর্থ প্রদানে সম্মতি দিয়েছেন মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন।
জানা গেছে, প্রকল্পের আওতায় লালদীঘি মাঠের পূর্ব পাশের সীমানা দেয়ালে (সিএমপি কার্যালয়) বসানো হবে ম্যুরাল। এ ম্যুরালে থাকবে ঐতিহাসিক ৬ দফা আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান ৭০ এর নির্বাচন, ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের কালজয়ী ভাষণরত বঙ্গবন্ধু, ২৫ মার্চের অপারেশন সার্চলাইটে রিকশার উপর পড়ে থাকা মৃতদেহের ছবি। আরো থাকবে মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির রুখে দাঁড়ানো, পাকবাহিনীর নির্মম গণহত্যা, ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যা এবং ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা অর্জনের চিত্র। এছাড়া সীমানা দেয়ালের কোণায় নির্মাণ করা হবে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য। সেটির উচ্চতা হবে প্রায় ১৩ ফুট। এর নিচে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর রেসকোর্স ময়দানে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর যৌথ টিমের কাছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের ইতিহাস স্বীকৃত ছবিটিও ভাস্কর্য আকারে স্থান পাবে। এছাড়া একটি ওয়াকওয়ে এবং লাইটিং করা হবে।
প্রসঙ্গত, লালদীঘি ময়দান কেবল একটি মাঠ নয়, বাঙালির স্বাধিকার আদায় আন্দোলনের প্রত্যক্ষ স্বাক্ষী। চট্টগ্রামের শত বছরের সংস্কৃতি চর্চার অন্যতম তীর্থস্থান এ মাঠ। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনসহ বাঙালি জাতির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সংগ্রামের স্মৃতি জড়িয়ে আছে এ মাঠের। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সভা–সমাবেশের পরিকল্পনার কেন্দ্রে থাকা এ মাঠের ঐতিহাসিক গুরুত্ব আজ চট্টগ্রামের গ-ি পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। ১০৮ বছর আগে এ মাঠে শুরু হওয়া জব্বারের বলী খেলাও এখন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ার অপেক্ষায়।
লালদীঘি মাঠটি একসময় মিউনিসিপ্যাল মাঠ নামে পরিচিত ছিল। ১৮৮৭ সালে লালদীঘি মাঠে মহারানি ভিক্টোরিয়ার মূর্তি স্থাপন করা হয়েছিল। চল্লিশের দশকে স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় এই মূর্তি অপসারণ করা হয়। ঊনবিংশ শতকের শেষে উত্তর–দক্ষিণ রাস্তাটি হওয়ার পর মাঠটি দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। পূর্ব দিকটি খেলার মাঠে পরিণত হয়। মাঠটির মালিক মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয়। লালদীঘি মাঠটি চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের আন্দরকিল্লা ওয়ার্ডে অবস্থিত।
লালদীঘি মাঠকে ঘিরে গৃহীত ‘গৌরবের ইতিহাস’ প্রকল্পের ডিজাইন করছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী চিত্রশিল্পী শ্রীকান্ত আচার্য। তিনি দৈনিক আজাদীকে বলেন, ১৯৫২ থেকে ১৯৭১ সালের ইতিহাস নিয়ে একটি ম্যুরাল হবে; যার আয়তন ৭ ফুট বাই ২০০ বা ১ হাজার ৪শ বর্গফুট। চট্টগ্রামে এটিই সবচেয়ে বড় ম্যুরাল হবে। এর পুরোটাই হবে টাইলসের উপর।
এ শিল্পী বলেন, শুরুতে থাকবে ’৫২ সালের ভাষা আন্দোলন। ভাষা নিয়ে যত আন্দোলন হয়েছে সেগুলো স্থান পাবে। ভাষা আন্দোলন নিয়ে প্রথম কবিতাটি লিখেছিলেন চট্টগ্রামের মাহবুব উল আলম চৌধুরী, ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি’। কবিতাটির একটি অংশ প্রিন্ট আকারে দেয়ালে সংযোজিত হবে। সাথে তাঁর একটি পোট্রেট থাকবে। এরপর থাকবে শহীদ মিনার। ভাষা আন্দোলনে আমাদের যে বিজয় সেটা এই শহীদ মিনারের মাধ্যমে উঠে আসবে।
১৯৫৬ সালে বঙ্গবন্ধুর ঘোষিত ছয় দফার উপর আলাদা ফোকাস থাকবে উল্লেখ করে শ্রীকান্ত আচার্য বলেন, ছয় দফার প্রতিটি দফা আলাদাভাবে টাইলসের উপর লেখা থাকবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কিন্তু লালদীঘি মাঠ থেকেই ছয় দফার ঘোষণা দিয়েছিলেন। তাই বিষয়টিকে আলাদাভাবে গুরুত্ব দিচ্ছি। বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দিচ্ছেন, টাইলসের উপর এমন একটি প্রতিকৃতিও থাকবে।
তিনি বলেন, এরপর ধারাবাহিকভাবে ১৯৬৯-এর গণ আন্দোলন বা ১১ দফা, বঙ্গবন্ধুর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা এবং সেখান থেকে মুক্ত হয়ে বের হওয়ার অংশ তুলে ধরা হবে। থাকবে ৭০- এর নির্বাচন প্রসঙ্গও। এরপর ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টি আসবে। এখানে ৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণ, ২৫ মার্চের কালরাত্রি, বাঙালিদের রুখে দাঁড়ানোর কিছু চিত্র থাকবে। ৭১ সালে বাঙালি শরণার্থীরা যে দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছিল, ওই শরণার্থীর ঢলের কিছু দৃশ্য থাকবে। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের কিছু ছবি থাকবে। এখানে নারীদের ওপর যে অত্যাচার–ধর্ষণ সেগুলোও থাকবে। নারীরা কিন্তু অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করেছে। তাদের বীরত্বগাথাও থাকবে। এরপর ১৬ ডিসেম্বরে আমাদের যে বিজয় অর্জন সেটি ফুটিয়ে তোলা হবে।
শিল্পী বলেন, একুশে ফেব্রশুয়ারি প্রথম কবিতাটি কিন্তু দৈনিক আজাদীর কোহিনুর ইলেকট্রিক প্রেস থেকে ছাপা হয়েছিল। এটাও ম্যুরালে অন্তর্ভুক্ত থাকবে। পাশাপাশি ১৯৭১ সালে আমাদের বিজয়ের খবরটিও কিন্তু দৈনিক আজাদী প্রথম ছাপিয়েছিল। অর্থাৎ ১৭ ডিসেম্বর দৈনিক আজাদীতে আনন্দের খবরটি ছাপানো হয়েছিল। ওই দিনের পত্রিকাটিও টাইলসের ম্যুরালে থাকবে। দেয়ালচিত্রের পর সীমানা দেয়ালের কর্নারে ১৩ ফিটের বঙ্গবন্ধুর একটি স্ট্যাচু বা ভাস্কর্য থাকবে। ওটার নিচে সাতজনের একটি স্কাল্পচার থাকবে। এই স্কাল্পচারে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর রেসকোর্স ময়দানে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর যৌথ টিমের কাছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের দৃশ্যটি থাকবে।
লালদীঘি মাঠে ‘গৌরবের ইতিহাস’ ম্যুরাল নির্মাণের মাধ্যমে বাঙালি জাতির দীর্ঘ ইতিহাস তুলে ধরার উদ্যোগ নিয়েছেন কাউন্সিলর জহর লাল হাজারী। তিনি দৈনিক আজাদীকে বলেন, লালদীঘি মাঠটি অনেক স্মৃতিবিজড়িত। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফার মাধ্যমে যে স্বাধীনতার বীজ বপন করেছিলেন সেটাও এই লালদীঘি মাঠ থেকে হয়েছিল। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অগ্রসৈনিক সূর্য সেনকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল লালদীঘি মাঠ সংলগ্ন কারাগারে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের আগে সর্বশেষ জনসেবা হয়েছিল এই মাঠে। লালদীঘি মাঠকেন্দ্রিক জব্বারের বলী খেলা ১১০ বছরে পদার্পণ করেছে। শহরের যে কোনো জনসভা, সমাবেশ লালদীঘি মাঠকে টার্গেট করে হয়ে থাকে। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনসহ বিভিন্ন আন্দোলন–সংগ্রাম এই লালদীঘি মাঠকে ঘিরে শুরু হয়েছে। এলাকার তিনবারের কাউন্সিলর হিসেবে এবং মহানগর আওয়ামী লীগের দপ্তর সম্পাদক হিসেবে লালদীঘির মাঠের এই ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখতে একটা উদ্যোগ গ্রহণ করি। পরবর্তীতে প্রকল্প তৈরি করে আমি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র দৈনিক আজাদীর সম্পাদক সাহেব এবং সিটি মেয়র মহোদয়ের কাছে উপস্থাপন করি। দুজনই প্রকল্প বাস্তবায়নে সম্মতি দেন।
তিনি বলেন, শিল্পী শ্রীকান্ত আচার্য ডিজাইন করেছেন। সেখানে ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয় পর্যন্ত আমাদের যত আন্দোলন–সংগ্রাম সবকিছু ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে আমাদের সুদীর্ঘ ইতিহাস এবং অর্জন সম্পর্কে নতুন প্রজন্ম জানতে পারবে। এর বাইরে একটি ওয়াকওয়ে করা হবে এবং লাইটের ব্যবস্থা থাকবে; যাতে রাতের বেলাও লোকজন মাঠে ব্যায়াম বা খেলাধুলা করতে পারেন।
হাজারী বলেন, বর্তমানে রাতের বেলা মাঠটি অরক্ষিত থাকে। ভবঘুরে ও মাদকসেবীরা আশ্রয় নেয়। এখন যদি লাইটের ব্যবস্থা থাকে, তাহলে মাঠটি সংরক্ষিত থাকবে। রাতের বেলায় হাঁটতে পারবেন এবং ব্যায়াম করতে পারবেন। প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে খোলার মাঠের কোনো তি হবে না। খেলার মাঠ যেভাবে আছে সেভাবেই থাকবে। কোনো গাছপালাও কাটা হবে না। পরিবেশের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে এমন কোনো কাজও আমরা করব না।
প্রকল্পের ব্যয় সম্পর্কে তিনি বলেন, প্রকল্পে মোট ব্যয় হবে ৪২ লাখ টাকা। এর মধ্যে দৈনিক আজাদী ২০ লাখ টাকা এবং বাকি টাকা সিটি কর্পোরেশন থেকে মেয়র মহোদয় প্রদান করবেন।