মালিক, শ্রমিক ও সচিব কমিটির ত্রিপক্ষীয় বৈঠক শেষে পাঁচ শতাংশ ইনক্রিমেন্টসহ গার্মেন্টস শ্রমিকদের সংশোধিত মজুরি কাঠামো ঘোষণা করেছে সরকার। ত্রিপক্ষীয় ওই বৈঠক শেষে সচিবালয়ে নতুন এই মজুরি কাঠামো ঘোষণা করেন শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মুন্নুজান সুফিয়ান। এসময় বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, শ্রম সচিব আফরোজা খান, বাণিজ্য সচিব মফিজুল ইসলাম, পোশাক কারখানা মালিকদের পক্ষে বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান, সালাম মুর্শেদী এমপি, আতিকুর রহমান, শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন, এ কে আজাদ এবং শ্রমিকদের পক্ষে নাজমা আকতার, ফজলুল হক মন্টু, আমিরুল ইসলাম আমিন সেখানে উপস্থিত ছিলেন। এর আগে শ্রম সচিব আফরোজা খানের নেতৃত্বে পোশাক কারখানা মালিক ও শ্রমিকদের মধ্যে এই ত্রিপক্ষীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠক শেষে নতুন মজুরি কাঠামো অনুমোদন করে তাতে শ্রমিক নেতারা স্বাক্ষর করেন বলে জানিয়েছেন শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মুন্নুজান সুফিয়ান। খবর বাসস, বিডিনিউজ ও বাংলানিউজের।
সমন্বয় করা মজুরি কাঠামোতে সপ্তম গ্রেডে কোনো বেতন বাড়েনি। ২০১৮ সালে সপ্তম গ্রেডে বেতন ছিল ৮ হাজার টাকা। নতুন সমন্বয়ে এই বেতন আগেরটাই রাখা হয়েছে। বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, সংশোধিত এই কাঠামো ২০১৮ সালের ১ ডিসেম্বর থেকেই কার্যকর ধরা হবে। বর্ধিত অংশের টাকা ফেব্রুয়ারির বেতনের সঙ্গে সমন্বয় করা হবে। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে মজুরি কাঠামোর ৭টি গ্রেডের মধ্যে ৬টি গ্রেডের বেতন বৃদ্ধি করা হয়েছে। এতে সর্বোচ্চ বেতন বেড়েছে ৫২৫৭ টাকা। আর সর্বনিম্ন ২৭০০ টাকা। আগামী সাত দিনের মধ্যে সংশোধিত কাঠামোর গেজেট প্রকাশ করা হবে জানিয়ে শ্রমিকদের কাজে ফেরার আহ্বান জানান বাণিজ্যমন্ত্রী, যিনি নিজেও গার্মেন্ট খাতের একজন উদ্যোক্তা। বৈঠকের বিষয়ে শ্রম সচিব আফরোজা খান জানান, ২০১৩ সালে ১ম গ্রেডে বেতন ছিল ১৩ হাজার টাকা। ২০১৮ সালে সেটি করা হয় ১৭ হাজার ৫১০ টাকা। সংশোধিত কাঠামো অনুসারে এক নম্বর গ্রেডে শ্রমিকরা এখন থেকে ১৮ হাজার ২৫৭ টাকা মজুরি পাবেন। ২০১৩ সালে ২য় গ্রেডে বেতন ছিল ১০ হাজার ৯০০ টাকা। ২০১৮ সালে সেটি করা হয় ১৪ হাজার ৬৩০ টাকা। সংশোধিত কাঠামো অনুসারে দ্বিতীয় নম্বর গ্রেডে শ্রমিকরা এখন থেকে ১৫ হাজার ৪১৬ টাকা মজুরি পাবেন। ২০১৩ সালে তৃতীয় গ্রেডে বেতন ছিল ৬ হাজার ৪০৫ টাকা। ২০১৮ সালে সেটি করা হয় ৯ হাজার ৫৯০ টাকা। সংশোধিত কাঠামো অনুসারে তৃতীয় নম্বর গ্রেডে শ্রমিকরা এখন থেকে ৯ হাজার ৮৪৫ টাকা মজুরি পাবেন। ২০১৩ সালে ৪র্থ গ্রেডে বেতন ছিল ৬ হাজার ৪২০ টাকা। ২০১৮ সালে সেটি করা হয় ৯ হাজার ২৪৫ টাকা। সংশোধিত কাঠামো অনুসারে ৪র্থ নম্বর গ্রেডে শ্রমিকরা এখন থেকে ৯ হাজার ৩৪৭ টাকা মজুরি পাবেন। ২০১৩ সালে ৫ম গ্রেডে বেতন ছিল ৬ হাজার ৪২ টাকা। ২০১৮ সালে সেটি করা হয় ৮ হাজার ৮৫৫ টাকা। সংশোধিত কাঠামো অনুসারে ৫ম নম্বর গ্রেডে শ্রমিকরা এখন থেকে ৮ হাজার ৮৭৫ টাকা মজুরি পাবেন। ২০১৩ সালে ৬ষ্ঠ গ্রেডে বেতন ছিল ৫ হাজার ৬৭৮ টাকা। ২০১৮ সালে সেটি করা হয় ৮ হাজার ৪০৫ টাকা। সংশোধিত কাঠামো অনুসারে ৬ষ্ঠ গ্রেডে শ্রমিকরা এখন থেকে ৮ হাজার ৮২০ টাকা মজুরি পাবেন। ২০১৩ সালে ৭ম গ্রেডে বেতন ছিল ৫ হাজার ৩০০ টাকা। ২০১৮ সালে সেটি করা হয় ৮ হাজার টাকা। চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে এটি ৮ হাজার টাকাই রাখা হয়েছে।
বৈঠক শেষে পোশাক মালিকদের পক্ষে এফবিসিসিআই’র সভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, গত কয়েকদিনে আন্দোলনের নামে যারা পোশাক কারখানা ভাঙচুর করেছে, তাদের কঠোর হাতে দমন করতে হবে। সম্পদ রক্ষায় সরকারকে সচেষ্ট হতে হবে। সরকার যেন কোনো অন্যায়কে প্রশ্রয় না দেয়। এসময় পোশাক শ্রমিকদের অনতিবিলম্বে কাজে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
পরে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, যারা ভাঙচুর করেছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। এই বিষয়ে একটি সিদ্ধান্তে আসা উচিত। এই কয়দিনে যে ক্ষতি হয়েছে শ্রমিকরা সবাই উদ্যোগী হয়ে কাজ করে পুষিয়ে দেবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি। বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, আন্দোলনে নিহত শ্রমিকের পরিবারের জন্য সরকারের নিয়ম অনুসারে ক্ষতিপূরণ পাবেন। আর আমি ব্যক্তিগতভাবে নিহতের পরিবারকে এক লাখ টাকা দেবো।
শ্রমিকদের পক্ষে জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি আমিরুল হক আমিন বলেন, সোমবার (আজ) থেকে শ্রমিকরা কাজে যোগ দেবেন। মজুরি কাঠামো নিয়ে যে অসামঞ্জস্য ছিল প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে তা সমাধান হয়েছে। আজকে যে মজুরি ঘোষণা হলো আমরা স্বাগত জানাই। তিনি বলেন, ট্রেড ইউনিয়ন হিসেবে আমরা আন্দোলন করব। তবে আন্দোলন মানে রাস্তা অবরোধ নয়, কারখানা ভাঙচুর নয়। এছাড়া এই কয়দিনে আন্দোলনের নামে যারা ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড করেছেন, তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিলে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে নিরপরাধ কেউ যেন হযরানি না হয়। এসময় গার্মেন্টস শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়নের সভাপতি মন্টু ঘোষ, বাংলাদেশ বিপ্লবী গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি সালাউদ্দিন স্বপন, গার্মেন্টস শ্রমিক কর্মচারী লীগের সভাপতি লিমা ফেরদাউস, মজুরি বোর্ডের সাবেক সদস্য সিরাজুল ইসলাম রনি ও জাতীয় শ্রমিক লীগের সভাপতি ফজলুল হক মন্টু উপস্থিত ছিলেন।
উল্লেখ্য, তৈরি পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি আট হাজার টাকা নির্ধারণ করে গত ২৫ নভেম্বর গেজেট প্রকাশ করে সরকার। ডিসেম্বরের ১ তারিখ থেকে তা কার্যকর করার নির্দেশনা দেওয়া হয় সেখানে। ওই মজুরি কাঠামোর কয়েকটি গ্রেডে বেতন কমে যাওয়ার অভিযোগ জানিয়ে গত ৬ জানুয়ারি থেকে ঢাকা ও আশপাশের গার্মেন্টস অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে বিক্ষোভ দেখায় পোশাক শ্রমিকরা। অনেক কারখানায় নির্ধারিত সময়ে নতুন মজুরি কাঠামো বাস্তবায়ন হয়নি বলেও শ্রমিকদের অভিযোগ রয়েছে।
শ্রমিকদের আন্দোলতের প্রেক্ষিতে গত ৯ জানুয়ারি শ্রম সচিবকে প্রধান করে ১২ সদস্যের পর্যালোচনা কমিটি করে শ্রম মন্ত্রণালয়। সেখানে মালিক পক্ষের পাঁচজন, শ্রমিক পক্ষের পাঁচজন ছাড়াও বাণিজ্য সচিবকে সদস্য করা হয়। পরদিন ওই কমিটির প্রথম বৈঠক শেষে শ্রম সচিব আফরোজা খান বলেন, নতুন কাঠামোর সাতটি গ্রেডের মধ্যে ৩, ৪ ও ৫ নম্বর গ্রেড নিয়ে শ্রমিকদের আপত্তি তারা আমলে নিয়েছেন এবং সেগুলো পর্যালোচনা করে তারা সমন্বয় করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
আন্দোলনকারীদের অভিযোগ ছিল, ২০১৩ সালে যখন সর্বশেষ বেতন বাড়ানো হয়, তখন তৃতীয় গ্রেডে মূল বেতন হয় ৪ হাজার ৭৫ টাকা। বছরে ৫ শতাংশ হারে বেতন বৃদ্ধির পর ওই গ্রেডের একজন শ্রমিকের মূল বেতন এখন ৫ হাজার ২০৪ টাকা হওয়ার কথা। আর নতুন কাঠামোতে তৃতীয় গ্রেডের মূল বেতন ঘোষণা করা হয়েছে ৫ হাজার ১৬০ টাকা। তাদের এই হিসাবে তৃতীয় গ্রেডে বেতন কমেছে ৪৪ টাকা; একইভাবে চতুর্থ গ্রেডের মূল বেতন ৭৯ টাকা এবং পঞ্চম গ্রেডে ১৬৪ টাকা বেড়েছে। অথচ সপ্তম গ্রেডে নতুন শ্রমিকদের বেতন বেড়েছে ২ হাজার ৭০০ টাকা।
পরে বিষয়টি সমাধানে পাঁচটি গ্রেডেই মজুরি সমম্বয়ের জন্য গত শনিবার নির্দেশ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শনিবার রাতে এ সমস্যার সমাধানে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ও সচিব এবং পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ-র নেতাদের গণভবনে ডেকে নেন প্রধানমন্ত্রী। এরপর তাদের সঙ্গে কথা বলে বিরাজমান সমস্যা নিরসনে প্রধানমন্ত্রী শ্রমিকদের স্বার্থে ৩, ৪ ও ৫ নম্বর গ্রেডের পাশাপাশি ১ ও ২ নম্বর গ্রেডের মজুরি সমন্বয়ের নির্দেশ দেন।