বিশ্বের রোল মডেল বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্ব

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিশ্বে একটি রোল মডেল বলে আখ্যায়িত করেছেন। আগামীতেও এই সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে বলে দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এসব বহুমুখি এবং বহুমাত্রিক সহযোগিতার ফলে আমাদের মধ্যকার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বিশ্ববাসীর সম্মুখে সু-প্রতিবেশী সুলভ সম্পর্কের দৃষ্টান্ত রূপে পরিগণিত হচ্ছে। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, ভবিষ্যতেও এ সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে।
গতকাল সোমবার দুপুরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বাংলাদেশের চারটি উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধনের সময় প্রদত্ত ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একথা বলেন।
তিনি বলেন, বিগত এক দশকে উভয় দেশের মধ্যে বিভিন্ন প্রথাগত খাত যেমন নিরাপত্তা, বাণিজ্য, বিদ্যুৎ, জ্বালানি, যোগাযোগ, অবকাঠামো উন্নয়ন, জলবায়ু ও পরিবেশ, নবায়নযোগ্য জ্বালানি, শিক্ষা, সংস্কৃতি, জনযোগাযোগ বৃদ্ধি এবং স্বাস্থ্য প্রভৃতি খাতে সহযোগিতা প্রভ‚ত পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। এর পাশাপাশি বিভিন্ন নতুন ও অপ্রচলিত খাত যেমন বøু ইকোনমি এবং মেরিটাইম, পরমাণু শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার, মহাকাশ গবেষণা, ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথ রপ্তানি এবং সাইবার সিকিউরিটি প্রভৃতি খাতে উভয় দেশ সহযোগিতার হাত স¤প্রসারিত করেছে বলেও জানান তিনি।
প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে ভারত থেকে দোতলা বাস, একতলা এসি ও নন-এসি বাস এবং ট্রাক আমদানি, ভারতীয় আর্থিক অনুদানে পাঁচ জেলায় (জামালপুর, শেরপুর, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া) ৩৬টি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন, ভারতীয় অনুদানে বরিশাল বিভাগের পিরোজপুর জেলার ভান্ডারিয়ায় ১১টি পানি শোধনাগার স্থাপন এবং সার্কভুক্ত দেশসমূহে ভারতের ন্যাশনাল নলেজ নেটওয়ার্ক (এনকেএন) সম্প্রসারণের আওতায় বাংলাদেশে উক্ত নেটওয়ার্কে সম্প্রসারণের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গণভবন থেকে এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী নয়া দিল্লীতে তার কার্যালয় থেকে ভিডিও কনফারেন্সে যোগদান করেন। ভারত এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীগণ একত্রে সুইচ চেপে প্রকল্পের ফলক উন্মোচন করেন। পরে ৪টি প্রকল্পের ওপরই অনুষ্ঠানে ভিডিও চিত্র প্রদর্শিত হয়। এসময় বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন এবং ভারতের বিদেশ মন্ত্রী সুষমা স্বরাজ বক্তব্য রাখেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার ভাষণে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ উচ্ছেদে তার সরকারের জিরো টলারেন্স নীতির উল্লেখ করেন। শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ সব ধরনের সন্ত্রাসবাদের প্রতি ‘শূন্য সহনশীলতা’র নীতি পোষণ করে এবং কোন সন্ত্রাসবাদী সংগঠনকে কখনই বাংলাদেশের মাটিতে আশ্রয় প্রদান করা হবে না। তিনি বলেন, দ্বিপাক্ষিক, আঞ্চলিক এবং বহুপাক্ষিক সহযোগিতার মাধ্যমে আমাদের এ অঞ্চল এবং এর বাইরে সন্ত্রাসবাদ দূর করতে আমরা বদ্ধপরিকর।
গত মাসে কাশ্মিরের পুলওয়ামায় সন্ত্রাসি হামলার নিন্দা করে শোকাহত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি কাশ্মীরের পুলওয়ামায় সন্ত্রাসী হামলায় নিহতদের পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি। একইসঙ্গে এই ঘৃণ্য সন্ত্রাসী হামলার তীব্র নিন্দা পুনর্ব্যক্ত করছি।
টানা তৃতীয়বারের মত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণের পর এটাই তার এবং নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে প্রথম ভিডিও কনফারেন্স উল্লেখ করে শেখ হাসিনা তার নির্বাচনে বিজয়ের জন্য অভিনন্দন জানানোয় মোদীকে ধন্যবাদ জানান।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটা অত্যন্ত পরিতৃপ্তির বিষয় যে আজ দ্বিতীয় লাইন অফ ক্রেডিট (এলওসি) এর আওতাভুক্ত কয়েকটি প্রকল্পের উদ্বোধন হতে যাচ্ছে। আমি অত্যন্ত আনন্দিত যে, এলওসি এর আওতায় ৬০০ বাস (৩০০ দোতলা বাস, ২০০ একতলা এসি বাস এবং ১০০ একতলা নন-এসি বাস) এবং ৫০০ ট্রাক (৩৫০টি ১৬-টন ট্রাক এবং ১৫০টি ১০-টন ট্রাক) বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্পোরেশনের বহরে যুক্ত হতে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি আশা করি, এর ফলে বাংলাদেশের যাত্রী সাধারণের দুর্ভোগ কিছুটা লাঘব হবে এবং আমাদের মহাসড়কগুলোর যানজট খানিকটা হলেও নিয়ন্ত্রণে আসবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের পাঁচ জেলায় ৩৬টি কমিউনিটি ক্লিনিক এবং ভান্ডারিয়ায় ১১টি পানি শোধনাগার ভারতীয় অনুদানে নির্মাণ করায় ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানান।
তিনি বলেন, বর্তমানে সারাদেশে প্রায় ১৪ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা হচ্ছে এবং এ ক্লিনিকসমূহ বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা খাতের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তার সরকারের স্বাস্থ্যখাতে গৃহীত কার্যক্রমগুলোর মধ্যে অন্যতম সফল এই কার্যক্রম অনুন্নত অঞ্চলসমূহে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা, পরিবার কল্যাণ এবং জনগণের সুষম পুষ্টি নিশ্চিতকরণে ইতিবাচক অবদান রাখছে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বাংলাদেশে ভারতের ন্যাশনাল নলেজ নেটওয়ার্ক (এনকেএন) এর সম্প্রসারণকেও সাধুবাদ জানিয়ে বলেন, আমি আশা করছি এর মাধ্যমে ভারতের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, গ্রন্থাগার, পরীক্ষাগার এবং স্বাস্থ্য ও কৃষি গবেষণা বিষয়ক প্রতিষ্ঠানসমূহের সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধির মাধ্যমে বাংলাদেশের গবেষকদের সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর উদ্দেশ্যে বলেন, আজ এসব প্রকল্পের যৌথ উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকায় আপনাকে আবারও ধন্যবাদ জানাচ্ছি। বাংলাদেশ ও ভারতের যেসব ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান প্রকল্পগুলোর সঙ্গে জড়িত এবং আজকের অনুষ্ঠানকে সাফল্যমন্ডিত করার জন্য যারা কাজ করেছেন তাদের সকলকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। তিনি ভবিষ্যতে দু’দেশের যৌথ সহযোগিতার মাধ্যমে এ ধরনের আরও বহু প্রকল্পের সাফল্যজনক সমাপ্তি উদযাপনের আশাও প্রকাশ করেন।
প্রধানমন্ত্রী এসময় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারত সরকার এবং জনগণের সহযোগিতার কথা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করে বলেন, আমাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তা এক চিরন্তন মাইলফলক হয়ে থাকবে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতিকে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের পরাধীনতার শৃঙ্খল হতে বাংলাদেশকে স্বাধীন করার উদাত্ত আহবান জানিয়েছিলেন। তার সে আহবানে সাড়া দিয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণ স্বতঃস্ফূর্ততার সঙ্গে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন এবং ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমরা চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করি বলে জানান। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের সেই ঐতিহাসিক ভাষণ ইউনেস্কো ঘোষিত ‘বিশ্ব ডকুমেন্টারি হেরিটেজ’-এ যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে স্থান পেয়েছে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তার ভাষণে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের ভ‚য়শী প্রশংসা করে বলেন, বাংলাদেশের উন্নতি ভারতের জন্য সবসময়ই একটি আনন্দের বিষয়তো রয়েছেই উপরন্তু আমাদের জন্য প্রেরণারও উৎস। ভারত-বাংলাদেশ সহযোগিতার প্রসঙ্গ টেনে মোদী বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য বিশাল লক্ষ্য স্থির করেছেন। ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে গড়ে তোলা এবং ২০৪১ সাল নাগাদ বাংলাদেশকে উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে গড়ে তোলায় তার রূপকল্পকে বাস্তব রূপ দিতে সহায়তা করা আমাদের জন্য গর্বের বিষয়। এক সাথে মিলে বিগত ৫ বছরে আমরা ভারত বাংলাদেশ সম্পর্কের সোনালি অধ্যায়ের জন্য কাজ করতে পারাকে আমি আমার জন্য অত্যন্ত সৌভাগ্যজনক বলে মনে করছি। মোদী বলেন, আমার পুরো বিশ্বাস রয়েছে বিগত ৫ বছর আমাদের জন্য যতটা গৌরবজনক ছিল তার চাইতে আগামী ৫ বছরে আমাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এর থেকেও অনেক উচ্চতায় আসীন হবে।
শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম এবং ড. মশিউর রহমান, এলজিআরডি এবং সমবায় প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান, ইউজিসি’র চেয়ারম্যান অধ্যাপক আব্দুল মান্নান, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মো. নজিবুর রহমান এবং প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক মো. আবুল কালাম আজাদ, পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক, প্রেস সচিব ইহসানুল করিম এবং ঢাকায় ভারতীয় হাই কমিশনার রিভা গাঙ্গুলী দাস এ সময় গণভবনে উপস্থিত ছিলেন।
বাংলাদেশ থেকে ভারতে সফররত সংসদ সদস্যদের প্রতিনিধি দলের সদস্যরা এসময় নয়া দিল্লীতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কার্যালয়ে উপস্থিত ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী পরে কমলাপুর বিআরটিসি’র প্রধান কার্যালয়, ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের কার্যালয়, পিরোজপুর জেলার ভান্ডারিয়া এবং জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জে ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত বিভিন্ন শ্রেণি পেশার জনগণের সঙ্গে মত বিনিময় করেন।

মোদির সঙ্গে
আ.লীগ প্রতিনিধি
দলের সাক্ষাৎ

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বাংলাদেশের জনগণকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে সোমবার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় তিনি এ শুভেচ্ছা জানান।
আওয়ামী লীগের উপদফতর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়ার নেতৃত্বে দলের তরুণ নেতাদের প্রতিনিধি দল গত রবিবার ভারত সফরে গেছে। এই প্রতিনিধি দলের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদি মতবিনিময় করেন।
আওয়ামী লীগ সূত্র জানায়, প্রতিনিধি দলের সদস্যরা সকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে গিয়ে দেখা করেন। নরেন্দ্র মোদি তাদের স্বাগত জানান এবং শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। মোদি বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের কাছে এ দেশের ভূয়সী প্রশংসা করেন। তিনি প্রতিনিধি দলের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং এ দেশের মানুষকে শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা জানান।

এই সাক্ষাতের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদীর মধ্যে একটি ভিডিও কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় প্রতিনিধি দল নরেন্দ্র মোদির পাশে ছিলেন।
উল্লেখ্য, ভারতের প্রভাবশালী একটি বেসরকারি রাজনৈতিক সংস্থার আমন্ত্রণে ভারত সফর করছে আওয়ামী লীগসহ আরও কয়েকটি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি দল। আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি দলে আরও আছেন সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম বাবু, নাহিম রাজ্জাক, নাঈমুর রহমান দুর্জয়, নিক্সন চৌধুরী, রাজী মোহাম্মদ ফখরুল, মাহি বি চৌধুরী প্রমুখ।