অর্থনীতি ডেস্ক : সাধারণ কাজের খরচ বিবেচনায় ডিপিপিতে (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব) দর চূড়ান্ত করা হয়। কিন্তু রাশিয়ার বৃহৎ জ্বালানি সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান গ্যাজপ্রমের ক্ষেত্রে হয়েছে কত টাকা দিতে হবে সে মোতাবেক ফরমায়েশি ডিপিপি। গ্যাজপ্রমের চাওয়া অনুযায়ী প্রত্যেকটি কূপেই ১০০ থেকে ১৩০ কোটি টাকা বেশি দেওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে।
দরপত্র ছাড়া বিশেষ আইনে গ্যাজপ্রমের সঙ্গে সম্পাদিত সবগুলো চুক্তি যাচাই-বাছাই করার দাবি উঠেছে। চড়াদরে দেওয়া দরপত্রে দেশের কয়েক হাজার কোটি টাকা হাতিয়েছে একটি সিন্ডিকেট। লুটপাটে জড়িতদের মুখোশ উন্মোচন করতে বিশেষ আইনে সম্পাদিত চুক্তি পর্যালোচনা কমিটির কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
আওয়ামী লীগের শাসনামলে গ্যাজপ্রমকে চড়াদরে কাজ দেওয়ার বিষয়টি ছিল ওপেন সিক্রেট। রাষ্ট্রীয় কোম্পানি বাপেক্স ৭০ থেকে ৮০ কোটি টাকায় যে কূপ খনন করতে পারে, একই কূপ খননে ২২০ কোটি টাকায় দেওয়া হয়েছে গ্যাজপ্রমকে। এভাবে ১৯টি কূপ খননে রাষ্ট্রের কয়েক হাজার কোটি টাকা অপচয়ের অভিযোগ উঠেছে। জ্বালানি খাতের সংশ্লিষ্টরা প্রথম থেকেই চড়াদরে কাজ দেওয়ার বিষয়ে আপত্তি করে আসছেন।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, কূপ খননে যা হয়েছে তাকে মহাসাগর ডাকাতি বলা যায়। তিনগুণ পর্যন্ত বিল দেওয়া হয়েছে বিনা দরপত্রে। প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র নিশ্চিত করা গেলে কয়েক হাজার কোটি টাকা বেঁচে যেতো।
আর যে কাজ রাষ্ট্রীয় কোম্পানি বাপেক্স করতে পারে সেই কাজ চড়াদরে ঠিকাদারকে দিতে হবে কেনো এমন প্রশ্ন তুলেছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড. বদরুল ইমাম। তিনি বার্তা২৪.কম-কে বলেছেন, যেখানে বাপেক্স কাজ করতে সক্ষম সেখানে বিদেশি কোম্পানিকে দেওয়াটা অন্যায় হয়েছে। বাপেক্সের কূপ গ্যাজপ্রমকে দিয়ে করানোর কোন যৌক্তিকতা দেখি না। কেনো বিদেশি কোম্পানি দিয়ে করাতে হলো এটা নিয়ে তদন্ত হওয়া উচিত।
আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে বিশেষ আইনে সম্পাদিত চুক্তিসমূহ পর্যালোচনার জন্য গত ৫ সেপ্টেম্বর একটি কমিটি করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। হাইকোর্ট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মঈনুল ইসলাম চৌধুরীকে প্রধান করে ৫ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি এই করা হয়েছে। কমিটির অন্যান্য সদস্যরা হলেন- বুয়েটের ইলেকট্রিক্যাল এন্ড ইলেকট্রনিক প্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক আবদুল হাসিব চৌধুরী, কেপিএমজি বাংলাদেশ সাবেক সিওও আলী আশরাফ, বিশ্বব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন, ইউনির্ভাসিটি অব লন্ডনের ফ্যাকাল্টি অব ল এন্ড সোশ্যাল সায়েন্স এর অধ্যাপক মোশতাক হোসেন খান।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকট মোকাবিলার কথা বলে ২০১০ সালে ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বিধান বৃদ্ধি (বিশেষ আইন) আইন’ প্রণয়ন করে সরকার।শুরুতে দুই বছরের জন্য আইনটি করা হলেও পরে ২০১২ সালে ২ বছর, ২০১৪ সালে ৪ বছর, ২০১৮ সালে ৩ বছর এবং সর্বশেষ ২০২১ সালে ৫ বছরের জন্য মেয়াদ বৃদ্ধি করা হয়। আইনটির ৯ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, এই আইনের অধীন কৃত বা কৃত বলিয়া বিবোচিত কোনো কার্য, গৃহীত কোনো ব্যবস্থা, প্রদত্ত কোনো আদেশ বা নির্দেশের বৈধতা সম্পর্কে কোনো আদালতের নিকট প্রশ্ন উত্থাপন করা যাইবে না।
বিশেষ আইন ব্যবহার করে মোট ১৯টি কূপ খননের কাজ দেওয়া হয় গ্যাজপ্রমকে। রাষ্ট্রীয় কোম্পানি বাপেক্স ৭০ থেকে ৮০ কোটি টাকায় যে কাজ করতে পারে, একই কূপ সোয়া ২০০ কোটি টাকায় দেওয়া হয়েছে। গাজপ্রমকে যখন কূপ প্রতি ২০০ কোটি টাকা করে দেওয়া হয়, ওই সময়ে বাপেক্স রূপগঞ্জ (২০১৫ সাল) কূপ খনন করেছে ৬১ কোটি টাকা খরচে। ওই প্রকল্পের ডিপিপিতে প্রাক্কলিত মূল্য ছিল ৯৭ কোটি টাকা, সেই কাজ বাপেক্স ৬১ কোটি টাকায় শেষ করে বাকি টাকা ফেরৎ দিয়েছে।
শ্রীকাইল ইস্ট-১ ও সালদা নর্থ-১ (২০১৬ সাল) কূপ দূটি খননে ব্যয় হয়েছে ১৪৪ কোটি টাকা। বলা হয় বাপেক্সকে রিগ ভাড়া দিতে হয়নি, সে কারণে খরচ কম। রিগ ভাড়া ধরলেও ধারের কাছে নেই গ্যাজপ্রমকে দেওয়া বিল। একটি কূপ খনন করতে আদর্শ সময় বিবেচনা করা হয় ৪৫ দিন, সে হিসেবে রিগ (দৈনিক ভাড়া ২০ হাজার ডলার/১২০ টাকা) ভাড়া দাঁড়ায় ১০ কোটি টাকার মতো। অর্থাৎ সব মিলিয়ে ৮২ কোটি টাকা ।
হাতে যখন এই পরিসংখ্যান তখন টবগী, ভোলা নর্থ এবং ইলিশা কূপ খননে ৬২ মিলিয়ন ডলারে চুক্তি করা হয়। যা বাংলা টাকায় তখন পড়েছিল সোয়া ২০০ কোটি টাকার মতো। বিভিন্ন সময়ে এভাবে কয়েকগুণ বেশি দরে ১৯টি কূপের কাজ দেওয়া হয় গ্যাজপ্রমকে। আরও ১৫টি কূপ খনন প্রস্তাব প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে ছিল। সবচেয়ে এগিয়ে ছিল বাপেক্সের ভোলা গ্যাসফিল্ডের ৫টি কূপ খনন প্রকল্প।
ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির আরেকটি মিটিং হলেই চূড়ান্ত হতো। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনে জাতি রক্ষা পেয়েছে অপচয় থেকে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান দায়িত্ব নিয়েই বিশেষ আইনে প্রক্রিয়াধীন থাকা প্রকল্প স্থগিত করে দিয়েছেন। যদিও গ্যাজপ্রমের এ দেশীয় এজেন্টরা এখনও হাল ছাড়েননি, তারা নানাভাবে তদবির অব্যাহত রেখেছে।
চড়াদরে কাজ পেতে গম ও পটাশ সারকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করতে চাইছে রাশান কোম্পানি গ্যাজপ্রম। অন্তর্বর্তী সরকারকে প্রলুব্ধ করতে বিনামূল্যে ৩০ হাজার টন পটাশ সার, ৫০ হাজার টন গম সরবরাহ করতে যাচ্ছে বলে জানা গেছে। ১ জাহাজ (৩০ হাজার টন) পটাশ এবং সরকার ৩০ হাজার টন গম চাইলেও কোম্পানিটি আগবাড়িয়ে ৫০ হাজার টন গম সরবরাহ করতে যাচ্ছে। এগুলো বন্যার্ত্যদের সহায়তা হিসেবে দেওয়া হচ্ছে।
গত ২৯ আগস্ট সচিবালয়ে কৃষি উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন বাংলাদেশে নিযুক্ত রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আলেকজান্ডার মান্টিটস্কি। ওই বৈঠকের পর বাংলাদেশকে বিনামূল্যে ৩০ হাজার মেট্রিক টন পটাশ সার দেওয়ার কথা জানানো হয়।
রাশিয়া সরকারের পক্ষ থেকে বলা হলেও মূলত গ্যাজপ্রম তথা তাদের এজেন্টরা পেছনে কলকাঠি নাড়ছেন বলে জানা গেছে। গ্যাজপ্রম অনুদানের মাধ্যমে ড. ইউনূস সরকারের ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করছেন। যাতে করে বাংলাদেশে চড়াদরে কূপ খননের কাজ অব্যাহত রাখা যায়।
আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার সুযোগ কাজে লাগিয়ে দুর্নীতি ও লুটপাটের বিরল নজির গড়েছে গ্যাজপ্রম। গ্যাজপ্রমের বাংলাদেশি এজেন্টরা দিনে দিনে দানবে পরিণত হয়েছিল। তাদের চাপে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বাপেক্সের প্রাণ যায়-যায় অবস্থা হয়েছে। দরপত্র ছাড়া বিশেষ আইনে কূপ খননের কাজ দিতে তাড়াহুড়ো ছিল চোখের পড়ার মতো।
প্রস্তাবিত ১৫টি কূপের প্রতিটিতে ২৩ মিলিয়ন ডলার হারে (১২০ টাকা) প্রায় ৪২০০ কোটি টাকায় চুক্তি করতে যাচ্ছিল বাংলাদেশ। ওই কাজগুলো বাপেক্স দিয়ে সর্বোচ্চ ১২০০ কোটি টাকায় করা সম্ভব। যার ভুরিভুরি নজির দেশের মধ্যেই বিদ্যমান, তারপরও চোখ বন্ধ করে ধারাবাহিকভাবে চড়াদরে কাজ দেওয়া হয়েছে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এমনও সব নজির রয়েছে যা একইসঙ্গে ভয়ানক বলা যায়। তবুও সেই ভয়াবহ কাজ করে গেছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীর সিন্ডিকেট। ২০১৪ সালে বাপেক্সের ৩৫৪তম বোর্ড সভায় শ্রীকাইল-৪ কূপ খননের প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। ৫৫৬তম বোর্ডসভায় ৬৪টি কোটি টাকার ডিপিপি (প্রকল্প উন্নয়ন প্রস্তাব) অনুমোদন করা হয়। অনুমোদিত ডিপিপি পেট্রোবাংলায় প্রেরণ করে। নিয়ম হচ্ছে পেট্রোবাংলা অনুমোদন সাপেক্ষে কাজ শুরু হবে। কিন্তু পেট্রোবাংলায় ৬৪ কোটি টাকার ডিপিপি অনুমোদন না দিয়ে ২০০ কোটি টাকার ডিপিপি প্রেরণ করতে বলে। বাধ্য হয়ে একই কাজের (একই গভীরতা) জন্য ২০০ কোটি টাকার ডিপিপি করা হয়। আর সেই কাজটি দেওয়া হয় গ্যাজপ্রমকে।
গ্যাজপ্রমকে কাজ দেওয়ার ক্ষেত্রে কিভাবে ডিপিপি হয়, এমন প্রশ্নের জবাবে বাপেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শোয়েব বলেন, আগে মূল্য চূড়ান্ত হয়, তারপর সেই অনুযায়ী ডিপিপি তৈরি করা হয়।
ভোলা গ্যাসফিল্ডে যখন গ্যাজপ্রমের রিগ বসা, তখন রিগ আনা নেওয়ার জন্য ৪.২৫ মিলিয়ন ডলার বিল ধরা হয় ডিপিপিতে। ২০১৭ সালে ভোলা নর্থ কূপ খনন করার পর বাপেক্সের ইয়ার্ডে রিগ রেখে দেয় গ্যাজপ্রম। রিগটি সরিয়ে না নেওয়ায় বাপেক্সের পক্ষ থেকে ইয়ার্ড ভাড়া দাবি করে চিঠি দেওয়া হয়। ঠিক সেই সময়ে বাপেক্স ৪.২৫ মিলিয়ন ডলার বিল দেয় মোবিলাইজেশনের জন্য। রামের রাজত্বকে হার মানায় সেসব কাহিনী।
এর পেছনে কলকাঠি নাড়ছেন মূলত ন্যাশনাল গ্রুপের চেয়ারম্যান রাশিয়া প্রবাসী বাংলাদেশি আব্দুস সাত্তার মিয়া (মিয়া সাত্তার)। রহস্য মানব মিয়া সাত্তার এক সময় রাশিয়ার বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। আওয়ামী লীগের ওপর মহলে দহরম মহরম থাকায় যা খুশি তাই করেছেন। অনেক বিতর্ক হলেও তার অপকর্ম থেমে থাকেনি।
গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়ে আওয়ামী লীগে পক্ষে জনমত গড়তে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন মিয়া সাত্তার। রাশিয়াতে ‘বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ সোসাইটি’ গঠন করে বিভিন্ন সভা-সেমিনারের আয়োজন করেন। এসব সেমিনার থেকে আমেরিকার বিরুদ্ধে বাংলাদেশে হস্তক্ষেপের অভিযোগ তোলা হয়। ওই সব আয়োজনে নেপথে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন মিয়া সাত্তার। আওয়ামী লীগের পতনের পর বোল পাল্টে ফেলার চেষ্টা করছেন মিয়া সাত্তার। এখন পটাশ সার ও গম দিয়ে নিজের লাইন ওপেন করতে চাইছেন। ১৫ কূপ থেকেই বাড়তি ৩ হাজার কোটি টাকা হাতাতে চান মিয়া সাত্তার।
গ্যাজপ্রমের বাংলাদেশ অফিসের কনসালট্যান্ট আমিরুল ইসলাম বার্তা২৪.কম-কে বলেছেন, আপনারা যে হিসাবের কথা বলছেন, এই হিসাব সঠিক নয়। আমরা বরং কমদামে কোয়ালিটি কাজ করছি। বাপেক্সের যে কূপ খননের খরচ দেখাচ্ছে, সেখানে রিগ ভাড়া, জনবলের বেতন, তার আনুসাঙ্গিক খরচ দেখাচ্ছে না। এগুলো ধরলে প্রত্যেকটি কূপ ২০০ কোটি টাকার ওপরে চলে যাবে। আমি অংক কষে দেখাতে পারবো।