বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে দক্ষিণ এশিয়ায় যে সকল মনীষী, পন্ডিত ও ইতিহাসবিদ মধ্যযুগের বাংলার ইতিহাস গবেষণায় খ্যাতি লাভ করেছেন তাঁদের মধ্যে ইতিহাসবিদ আবদুল করিম অন্যতম। তাঁর ইতিহাস চর্চার মূল বিচরণ ক্ষেত্র হলো বাংলার ইতিহাসের মধ্যযুগ তথা মুসলিম শাসিত বাংলার ইতিহাস। বাংলার ইতিহাসের আধুনিক যুগের উপর ব্যাপক গবেষণা হলেও মধ্যযুগের উপর গবেষণা কর্ম অদ্যাবধি বেশ অপ্রতুল। কেননা এ সময়ের ইতিহাস চর্চার কাজ যেমন কষ্টসাধ্য, তেমনি তথ্য-উপাত্তের দুষ্প্রাপ্যতার কারণ নিহিত। তদুপরি আজকের দিনে আরবি ও ফারসি ভাষা জানা লোকের অভাব। ফলশ্রুতিতে এক্ষেত্রে একদিকে যেমন গবেষণার পরিব্যাপ্তি সংকোচিত, অন্যদিকে আমাদের জাতীয় চেতনার ইতিহাসের সবচেয়ে প্রারম্ভিক অধ্যায় নিদারুণভাবে অবহেলিত ও উপেক্ষিত হয়ে আছে। এমতাবস্থায় এ প্রতিভাবান ইতিহাসবিদ আবদুল করিম আরবি, ফারসি ও বাংলা ভাষায় লিখিত সমসাময়িক গ্রন্থাবলি, শিলালিপি, মুদ্রা এবং সুফি-সাধকদের জীবনচরিত থেকে তথ্য সংগ্রহ করে বাংলায় মুসলিম শাসনামলের ইতিহাসের পুনর্গঠন করে বেশ কয়েকটি মূল্যবান গ্রন্থ এবং অনেকগুলো গবেষণামূলক প্রবন্ধ প্রণয়ন করে মধ্যযুগের বাংলার ইতিহাস তথা সুলতানি ও মোগল আমল সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা প্রদানে সক্ষম হয়েছেন। গভীর অনুসন্ধিৎসা, একনিষ্ঠ অনুশীলন, মেধা ও মনন, নিরলস প্রচেষ্টা, পরিশ্রম, অধ্যবসায় এবং ভাষাগত পান্ডিত্যের কারণে তিনি মধ্যযুগের বাংলার ইতিহাসের নতুন নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে একজন সত্যানুসন্ধানী ইতিহাসবিদ হিসেবে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন এবং এ যুগের একজন বিশেষজ্ঞ পন্ডিত হিসেবে দেশ-বিদেশে খ্যাতি লাভ করেছেন।
ইতিহাসবিদ আবদুল করিম ১ জুন ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম জেলার বাঁশখালী উপজেলার চাপাছড়ি গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত সৈয়দ কাজির বংশের অতি সাধারণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কলকাতার কাজি উল-কুজ্জাত এবং বাঁশখালীর প্রসিদ্ধ আলিম ও সুফি মাওলানা আবদুল হাকিমের পৌত্র কাজি আবদুল বারীর বংশধর ছিলেন। তাঁর পিতা ও মাতার নাম হলো যথাক্রমে সৈয়দ ওয়াইজ উদ্দিন ও সৈয়দা রাশিদা খাতুন। তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট। বাবা দেশে না থাকার কারণে তিনি মাতৃস্নেহে লালিত-পালিত হন। এ সময় তাঁর মা ছিলেন সর্বেসর্বা। তিনি অত্যন্ত গুণী মহিলা ছিলেন। তিনি আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত না হলেও এর কদর বুঝতেন। ভারতের বিখ্যাত সাহারানপুর মাদ্রাসা থেকে আরবি ও ইসলামি জ্ঞানবিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষা লাভ করে স্বীয় গ্রামে আগত মৌলবি মুহাম্মদ মুনিরুজ্জামান চৌধুরী (মৃ. ১৯৬৩ খ্রি.) নিকট তাঁর হাতেখড়ি হয়। তিনি চাপাছড়ি ও বাহারচড়া গ্রামের প্রাথমিক শিক্ষা সমাপন করে বৈলছড়ি জুনিয়র মাদ্রাসা থেকে ষষ্ঠ শ্রেণির ফাইনাল পরীক্ষা কৃতিত্বের সাথে পাশ করেন। জন্মস্থানে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করে চট্টগ্রাম শহরে চলে আসেন এবং ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজ প্রকাশ মোহসিনিয়া মাদ্রাসায় সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন। এখানে ভর্তি হওয়াকে আবদুল করিম তাঁর জীবনে শুভদিন বলে অভিহিত করেছেন। কেননা এখানে ভর্তি হবার ফলে তাঁর জীবনে উচ্চশিক্ষা লাভের ভাগ্য নির্ধারিত হয়।
পরবর্তীতে চট্টগ্রাম ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে হাই মাদ্রাসা পরীক্ষা এবং ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে অনার্স কোর্সে ভর্তি হন। ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে কৃতিত্বের সাথে স্নাতক সম্মান এবং ১৯৫০ খ্রিস্টব্দে স্নাতকোত্তর এ প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করার গৌরব অর্জন করেন। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাজীবন শেষ করে তিনি প্রথমে বর্তমান নারায়ণগঞ্জ জেলার মুড়াপাড়া ভিক্টোরিয়া হাইস্কুলে কিছুদিন শিক্ষকতা করেন। ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে প্রভাষক পদে যোগদান করেন। মেধাবী ও তীক্ষ বুদ্ধিসম্পন্ন আবদুল করিম অল্পদিনের মধ্যে শিক্ষকতায় সুনাম অর্জন করেন। শিক্ষকতার মহান পেশায় জড়িত হবার সুবাদে তিনি ইতিহাস গবেষণায় আত্মনিয়োগ করেন। তাঁর শিক্ষকদের বিশেষ করে তৎকালীন বিভাগীয় প্রধান বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ আবদুল হালিম এর অনুপ্রেরণা ও পরামর্শে তিনি বিশিষ্ট প্রত্নতত্ত্ববিদ ও ইতিহাসবিদ আহমদ হাসান দানীর তত্ত্বাবধানে গবেষণা কর্মে মনোনিবেশ করেন। ফলশ্রুতিতে ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে Social History of the Muslims in Bengal Down To A. D. 1538 শীর্ষক অভিসন্দর্ভ রচনা করে প্রথম পিএইচ. ডি. ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ১৯৬০-’৬২ খ্রিস্টাব্দে ইতিহাসবিদ জে. বি. হ্যারিসনের গবেষণা তত্ত্বাবধানে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন School of Oriental and African Studies থেকে Murshid Quli Khan and His Times শিরোনামে অভিসন্দর্ভ রচনা করে স্বল্প সময়ে দ্বিতীয় পিএইচ. ডি. ডিগ্রি অর্জন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করার পর ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি ইতিহাস বিভাগে রিডার ও বিভাগীয় প্রধান হিসেবে যোগদান করেন এবং তিনিই নব প্রতিষ্ঠিত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বপ্রথম শিক্ষক হিসেবে ২ নভেম্বর ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে যোগদান করেন। ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসের মধ্যে এ নতুন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র-শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারি, ছাত্রাবাস, কেন্টিনসহ পুরোপুরিভাবে চালু হয়ে যায়। নতুন এ বিশ্ববিদ্যালয়কে সর্বাঙ্গীণভাবে সুন্দরভাবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও তিনি কঠোর ও নিরলসভাবে পরিশ্রম করে অনবদ্য ভূমিকা পালন করেন।
সুদীর্ঘ সময় শিক্ষকতার মহান দায়িত্ব পালনের পর ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণ করে তিনি বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানে ইতিহাস চর্চায় নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৮৫ থেকে ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে তিনি চট্টগ্রামস্থ বায়তুশ শরফ ইসলামি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় তাঁর গবেষণার কাজ অব্যাহত গতিতে পরিচালিত হয় এবং ব্যাপক উৎকর্ষ লাভ করে। তিনি এ গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মুখপত্র ইসলামী ঐতিহ্য এর সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেন। তাছাড়া ১৯৮৯ থেকে ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাধীন ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ বা আই. বি. এস. এ সিলেক্শন গ্রেড প্রফেসর পদ মর্যাদায় ‘সিনিয়র ফেলো’ হিসেবে যোগদান করে মধ্যযুগের বাংলার মোগল আমলের ইতিহাস চর্চায় অসামান্য অবদান রাখেন। এ সময় তিনি পাঁচ খন্ডে বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় বাংলার মোগল যুগের ইতিহাস রচনার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। ১৯৯২ থেকে ১৯৯৬ সময়কালে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে ‘সুপারনিউমারারি প্রফেসর’ হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এ সময় তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘সেন্টার ফর হিস্টোরিক্যাল স্টাডিজ’ নামে একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল পর্ষদে এর নিয়মকানুন পাশ করার পর যথারীতি প্রতিষ্ঠা লাভ করে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, মাত্র অল্প কিছুদিনের মধ্যে এর কার্যক্রম স্থগিত হয়ে যায়। পরিশেষে একাডেমিক ক্ষেত্রে বিরল ও গৌরবময় কৃতিত্বের সম্মানজনক স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ১৪ জানুয়ারি ২০০১ খ্রিস্টাব্দ থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে প্রথম ‘ইমেরিটাস প্রফেসর’ পদে যোগদান করেন এবং মৃত্যু-অবধি তিনি উক্ত পদে নিয়োজিত ছিলেন।
বিশ্ববরেণ্য ইতিহাসবিদ ড. আবদুল করিম সমগ্র জীবনে মধ্যযুগের বাংলার মুসলমানদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন। তিনি অসংখ্য গবেষণাগ্রন্থ রচনা সকরে বাংলার ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছেন। এসব গ্রন্থের অধিকাংশই বাংলা একাডেমি, এশিয়াটিক সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত হয়। ঢাকা, চট্টগ্রাএমর বিভিন্ন প্রকাশনী থেকেও বেশ সকয়েকটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়।
যে সকল ইতিহাস গ্রন্থ রচনা করে খ্যাতি লাভ করেছেন তাহলো : Social History of the Muslims in Bengal (Down to A. D.1538), Chittagong : Baitush Sharaf Islamic Research Institute, Second Revised Edition 1985. (First Published : 1959) বাংলা অনুবাদ : মোকাদ্দেসুর রহমান, বাংলার মুসলমানদের সামাজিক ইতিহাস (১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত), ঢাকা : বাংলা একাডেমী, ১৯৯৩; Corpus of the Muslim Coins of Bengal (Down to A. D. 1538), Dacca : Asiatic Society of Pakistan, 1960; Murshid Quli Khan and His Times, Dacca : Asiatic Society of Pakistan, 1963১৯৬৩. বাংলা অনুবাদ : মোকাদ্দেসুর রহমান, মুর্শিদকুলী খান ও তাঁর যুগ, ঢাকা : বাংলা একাডেমী, ১৯৮৯; Dacca The Mughal Capital, Dacca : Asiatic Society of Pakistan, 1964. . বাংলা অনুবাদ : মোহাম্মদ মুহিবউল্যাহ ছিদ্দীকী, মোগল রাজধানী ঢাকা, ঢাকা : বাংলা একাডেমী, প্রথম পুনর্মুদ্রণ ২০০৩ (প্রথম প্রকাশ : ১৯৯৪); atalogue of Coins in the Cabinet of the Chittagong University Museum, Chittagong : Chittagong University Museum, 1979; Corpus of the Arabic and Persian Inscriptions of Bengal, Dhaka : Asiatic Society Of Bangladesh. 1992; History of Bengal : Mughal Period, Vol. 1, Rajshahi : Institute of Bangladesh Studies, Rajshahi University, 1992; History of Bengal : Mughal Period, Vol. 2, Rajshahi : Institute of Bangladesh Studies, Rajshahi University, 1995; The Rohingyas (A Short Account of their History & Culture), Chittagong : Arakan Historical Society, 2000; ঢাকাই মসলিন, ঢাকা : ঢাকা নগর জাদুঘর, ১৯৬৫; ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম শাসন, ঢাকা : বড়াল প্রকাশনী, ষষ্ঠ পুনর্মুদ্রণ ও সংস্করণ ২০০৭, (প্রথম প্রকাশ : ১৯৬৯); হযরত শাহ সুফী আমানত খান, চট্টগ্রাম : শাহজাদা বেলায়েত উল্লা খান, প্রথম মুদ্রণ, ১৩৭৬; চট্টগ্রামে ইসলাম, চট্টগ্রাম : ইসলামী সাংস্কৃতিক কেন্দ্র, দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৯৮০ (প্রথম সংস্করণ : ১৯৭০); নসরুল্লাহ খন্দকার বিরচিত শরীয়তনামা (ভূমিকাসহ সম্পাদিত), ঢাকা : কাকলী প্রকাশনী, ২০০২ (প্রথম প্রকাশ : ১৯৭৫); বাংলার সুফী সমাজ, ঢাকা, ১৯৮০; বাংলার ইতিহাস : সুলতানী আমল, ঢাকা : জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশ, চতুর্থ সংস্করণ ১৯৯৯ (প্রথম প্রকাশ : ১৯৭৭); ঈসা খান মসনদ ই আলা, ঢাকা : ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ১৯৮০; মক্কা শরীফে বাঙ্গালী মাদ্রাসা, চট্টগ্রাম : বায়তুশ শরফ ইসলামী গবেষণা প্রতিষ্ঠান, ১৯৮৭; মোল্লা মিসকিন শাহ্ (র:), চট্টগ্রাম : বায়তুশ শরফ ইসলামী গবেষণা প্রতিষ্ঠান, ১৯৮৭; সুলতান ফীরূজশাহ তুঘলক বিরচিত ফুতূহাত-ই-ফীরুজ শাহী (বাংলা অনুবাদ, ভূমিকা ও টিকাসহ), ঢাকা : এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ, ১৯৮৯; বাংলার ইতিহাস : মোগল আমল, প্রথম খন্ড, ঢাকা : জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশ, দ্বিতীয় মুদ্রণ ২০০৭, (প্রথম প্রকাশ : ১৯৯২); আবদুল করিম সাতিহ্য বিশারদ জীবন ও কর্ম, ঢাকা : বাংলা একাডেমী, ১৯৯৪; বাংলা সাহিত্যের কালক্রম, (মধ্যযুগ), ঢাকা : বাংলা একাডেমী, ১৯৯৪; রোসাঙ্গে বাংলা সাহিত্য (আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ স্মারক বক্তৃতা), চট্টগ্রাম : বাংলা সাহিত্য সমিতি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৯৪; আবদুল হক চৌধুরী ও তাঁর গবেষণা কর্ম, ঢাকা : বাংলা একাডেমী, ১৯৯৭; বাংলার ইতিহাস (১২০০-১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দ), ঢাকা : বড়াল প্রকাশনী, ১৯৯৯; বাঁশখালীর ইতিহাস ও ঐতিহ্য, চট্টগ্রাম : মোহাম্মদ মুজিবুর রহমান, ১৯৯৭; ইসলামের ইতিহাস (পশ্চিম এশিয়া, স্পেন ও উত্তর আফ্রিকা), ঢাকা : ১৯৯৮; ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস : মুসলমান আমল, চট্টগ্রাম, ১৯৯৮; চট্টগ্রামের ইসলামী ঐতিহ্য, চট্টগ্রাম : প্রজ্ঞালোক প্রকাশনী, ২০০২; মুসলিম বাংলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য, ঢাকা : কাকলী প্রকাশনী, (প্রথম প্রকাশ : ১৯৯৪), ২০০২; আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদের প্রবন্ধ সংগ্রহ (বিষয় : আলাওল), ঢাকা : জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশন, ২০০৩; সমাজ ও জীবন, (আত্মজীবনী), প্রথম খন্ড, ঢাকা : জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ, ২০০৮, (প্রথম প্রকাশ : হাসি প্রকাশনী, ২০০৩); সমাজ ও জীবন, (আত্মজীবনী), দ্বিতীয় খন্ড, ঢাকা : জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ, ২০০৮; আবদুল হক চৌধুরী রচনাবলী, প্রথম খন্ড, (সম্পাদিত), বাংলা একাডেমী, ২০১১; আবদুল হক চৌধুরী রচনাবলী, দ্বিতীয় খন্ড, (সম্পাদিত), বাংলা একাডেমী, ২০১৩; বখশী হামিদের মসজিদ, ঢাকা : এশিয়টিক প্রেস। এ সকল গ্রন্থ ছাড়াও বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় রচিত তাঁর প্রায় দুশত গবেষণা প্রবন্ধ দেশ-বিদেশের জার্নালে প্রকাশিত হয়।
বাংলার ইতিহাস চর্চার পাশাপাশি প্রফেসর ড. আবদুল করিম অসাধারণ সাংগঠনিক ও প্রশাসনিক দক্ষতার অধিকারী ছিলেন। ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার মহান ব্রত পালনের পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে সহকারী হাউজ টিউটর ও হাউজ টিউটরের দায়িত্ব পালন করেন। অন্যদিকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের পর থেকে একাডেমিক ও অবকাঠামোগত উৎকর্ষ সাধনে কঠোর পরিশ্রম করেন। তিনি বিভাগীয় প্রধান/সভাপতি (১৯৬৬-১৯৭৫), আলাওল হলের প্রভোষ্ট (১৯৬৬-১৯৭০), কলা অনুষদের ডিন (১৯৭০-১৯৭৫), সিনেট সদস্য ও সিনেট কর্তৃক নির্বাচিত সিন্ডিকেট সদস্য থাকাকালে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন একাডেমিক ও উন্নয়নমূলক কাজে এত বেশি জড়িয়ে পড়েন যে তখন তাঁর সম্পর্কে একটি মুখরোচক প্রবচন ছিল “চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকে যদি ১০০টি কমিটি, তবে প্রফেসর আবদুল করিম ১০১টি কমিটির চেয়ারম্যান/মেম্বার অর্থাৎ তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে গঠিত সকল কমিটির সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন।” বিশেষ করে তিনি ১৯৭৫ থেকে ১৯৮১ মেয়াদকালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের গুরু দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় বিশ্ববিদ্যায়ের একাডেমিক ও অবকাঠামোগত অনেক উন্নয়ন সাধিত হয়। একজন প্রশাসক হিসেবে তিনি বিচক্ষণ এবং দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ছিলেন। বিভিন্ন প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনকালেও বাংলার ইতিহাস গবেষণার ক্ষেত্রে বিন্দুমাত্র ছেদ পড়েনি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালীন ইতিহাস বিভাগ, কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি, মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠা এবং সর্বোপরি বিশ্ববিদ্যালয়কে সর্বাঙ্গীণ সুন্দরভাবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে অধ্যাপক ড. আবদুল করিমের ভূমিকা ও অবদান উল্লেখযোগ্য। বাংলার ইতিহাস পুনর্গঠনে যেমন দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন তেমনি সভাসমিতি ও গঠনমূলক কাজে তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে এশিয়াটিক সোসাইটি অব পাকিস্তান (বর্তমানে এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ) প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে একজন জুনিয়র সদস্য হিসেবে তিনি নিবিড়ভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। এ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তাঁর অবদান ছিল অসামান্য। তিনি সোসাইটির কাউন্সিলর এবং ১৯৬৪-১৯৬৬ মেয়াদকালে সাধারণ সম্পাদক হিসেবে একনিষ্ঠভাবে দায়িত্ব পালন করেন। সোসাইটির জার্নালে তাঁর অনেকগুলো প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। এমনকি সোসাইটি থেকে তাঁর বেশ কয়েকটি মৌলিক ও গবেষণা গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। সোসাইটি কর্তৃক ঐরংঃড়ৎু ড়ভ ইধহমষধফবংয সিরিজের সম্পাদনা পরিষদের তিনি বরিষ্ট সদস্য ছিলেন। তাছাড়া বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি কর্তৃক প্রকাশিত বাংলাপিডিয়ায় তাঁর রচিত বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় দু’শতাধিক ভূক্তি রয়েছে। এজন্য একজন ইতিহাসবিদ হিসেবে তাঁর সুনাম ও সুখ্যাতির জন্য তিনি এশিয়াটিক সোসাইটির অবদানকে কৃতজ্ঞচিত্তে স্বীকার করতে কুন্ঠাবোধ করেননি। আবদুল করিম ইতিহাস চর্চায় উৎসাহী প্রতিষ্ঠানের সাথে ঘনিষ্টভাবে জড়িত ছিলেন।
১৯৭৩-১৯৭৭ সময়কালে তিনি ‘বাংলাদেশ ইতিহাস সমিতি’ এর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগ প্রতিষ্ঠা এবং এর সার্বিক উন্নয়নে দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি তিনি ‘রিচার্স সোসাইটি অব পাকিস্তান’ নামে একটি গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। কিন্তু নানা কারণে তা সফলতার মুখ দেখেনি। তবে তিনি এ বিভাগ থেকে তাঁর সম্পাদনায় ইতিহাস পত্রিকা নামে একটি গবেষণা জার্নাল প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। যা অদ্যাবধি বিভাগের মাধ্যমে অনিয়মিতভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। তাছাড়া তিনি রয়েল এশিয়াটিক সোসাইটি অব গ্রেট বৃটেন এ্যান্ড আয়ারল্যান্ড, লন্ডন এর সম্মানিত ফেলো, চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতাল ও চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় ঈদ জামাত কমিটির জীবন সদস্য ছিলেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার সময় প্রফেসর ড. আবদুল করিম লক্ষ্য করলেন যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্দিকের মানুষ শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত, আশপাশে তেমন কোনো শিক্ষিত লোক ছিল না। বিশেষ করে হাটহাজারী এলাকা শিক্ষাদীক্ষায় অনেক পশ্চাৎপদ, স্কুল থাকলেও কোনো কলেজ তখনও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তাই তাঁর আহবানে সাড়া দিয়ে কিছু উদ্যমী যুবক ও শিক্ষাবিদ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিডার ইনস্টিটিউট হিসেবে ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দে ‘হাটহাজারী কলেজ’ প্রতিষ্ঠা করেন। একই সময় তিনি জন্মস্থান বাঁশখালীতে শিক্ষার আলোকবর্তিকা ছড়িয়ে দিতে ‘বাঁশখালী কলেজ’ প্রতিষ্ঠায় মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। পরবর্তীতে ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে পশ্চিম বাঁশখালীতে ‘পশ্চিম বাঁশখালী উপকূলীয় ডিগ্রি কলেজ’ নামে আরেকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। ফলে গ্রামের পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠী বিশেষ করে নারীদের উচ্চশিক্ষার দ্বার উন্মোচন করেন। এমনকি মৃত্যুর পূর্ব অবধি তিনি এ কলেজের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। তাছাড়া চট্টগ্রাম ভেটেরিনারী কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরে মূল্যবান ভূমিকা পালন করেন। বলা যায় আবদুল করিম কর্মজীবনে শিক্ষকতার পাশাপাশি বিভিন্ন সভাসমিতি, স্কুল-কলেজ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সাথে নিবিড়ভাবে জড়িত ছিলেন। উপমহাদেশ ছাড়াও যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, ইরান, সৌদি আরব, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুরসহ প্রভৃতি দেশে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সেমিনারে অংশগ্রহণ করেন।
সুদীর্ঘ গবেষণা জীবনে বাংলার ইতিহাস চর্চা ও অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ প্রফেসর ড. আবদুল করিম দেশ-বিদেশে অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেন। বিশেষ করে ন্যুমিজম্যাটিক সোসাইটি অব ইন্ডিয়া কর্তৃক ‘আকবর সিলভার মেডেল’ (১৯৬০), জাতিসংগের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষ্যে ইন্টারন্যাশনাল এসোসিয়েশন ফর রিলিজিয়াস ফ্রিডম কর্তৃক ‘শান্তি পুরস্কার’ (১৯৯৫), গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ‘একুশে পদক’ (১৯৯৫), এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ এর ‘সম্মানিত ফেলো’ (১৯৯৫), ওয়ার্ল্ড সিটিজেনশীপ আইডেনটিটি কার্ড (১৯৯৫), ওয়ার্ল্ড স্পিরিচ্যুয়াল ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়র্ক এ ভিজিটিং প্রফেসর (অনারারি) ১৯৯৫, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭৫ বৎসর পূর্তি উপলক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলামনাই এসোসিয়েশন কর্তৃক সম্মাননা (১৯৯৬), বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর কর্তৃক ‘বিশেষ সম্মাননা’ (২০০০), বায়তুশ শরফ আন্জুমান ইত্তেহাদ বাংলাদেশ কর্তৃক গুণীজনরূপে সংবর্ধনা ও পুরস্কার (২০০০), বৃহত্তর চট্টগ্রাম উন্নয়ন সংগ্রাম কর্তৃক আয়োজিত চট্টগ্রাম সম্মিলন এর গুণীজন সংবর্ধনা (২০০১), ড. মুহম্মদ এনামুল হক পদক (২০০২), আবদুল হক চৌধুরী স্বর্ণপদক (২০০২), প্রিন্সিপাল আবুল কাশেম সাহিত্য একাডেমী পদক (২০০৩), বাংলাদেশ ইতিহাস সমিতি স্বর্ণপদক (২০০৫), ঢাকাস্থ চট্টগ্রাম সমিতি কর্তৃক চট্টগ্রাম পদক (২০০৫), ইসলামিক আর্টস অরগানাইজেন কর্তৃক সম্মাননা ক্রেষ্ট (২০০৫), মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী গবেষণা পরিষদ কর্তৃক স্বর্ণপদক (২০০৬), বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি প্রেসিডেন্ট গোল্ড মেডেল (২০০৬), সাদত আলী আখন্দ পুরষ্কার (২০০৭), ইতিহাস একাডেমি ঢাকা কর্তৃক মরণোত্তর স্বর্ণপদক (২০১৪) প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। অবশেষে এ কীর্তিমান ইতিহাসবিদ ২৪ জুলাই ২০০৭ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন এবং চট্টগ্রাম শহরের হযরত গরীবুল্লাহ শাহ (রহ.) এর মাজার গেইট সংলগ্ন কবরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়।
বহুমুখী প্রতিভাবান বিদগ্ধ পন্ডিত, অসাধারণ গুণী শিক্ষাবিদ ও বিশ্ববরেণ্য ইতিহাসবিদ ড. আবদুল করিম বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে মধ্যযুগের বাংলার ইতিহাস গবেষণায় অসামান্য অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছেন। তাঁর বাংলার ইতিহাস গবেষণার ফলে বাঙালি মুসলমানরা বা মুসলমান বাঙালিরা তাঁদের ইতিহাস নিয়ে গৌরববোধ করতে পারে। মধ্যযুগের বাংলার ইতিহাসের একজন যশস্বী পন্ডিত, ইতিহাসবিদ ও প্রতœতত্ত¡বিদ হিসেবে তিনি সমাদৃত, স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে আছেন
তথ্যসূত্রে- দৈনিক পূর্বদেশ