খুব ভোরে চেঙ্গী, ফেনী ও মাইনী নদীতে ফুল ভাসানোর মধ্য দিয়ে খাগড়াছড়িতে শুরু হয়েছে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর ঐতিহ্যবাহী প্রধান সামাজিক ও প্রাণের উৎসব ‘বৈসাবি’। ফুল বিজুকে কেন্দ্র করে গতকাল শুক্রবার সকাল থেকে নদীর পাড়গুলো হাজারো তরুণ-তরুণীর মিলনমেলায় পরিণত হয়। বৈসাবি উৎসব উপভোগ করতে বিপুল সংখ্যক পর্যটক এখন খাগড়াছড়িতে। পাহাড়ি সম্প্রদায়ের বিভিন্ন বয়সের ছেলে-মেয়ে, তরুণ-তরুণী আনন্দ উল্লাসে ফুল তুলে গঙ্গা দেবীর উদ্দেশ্যে নদীতে ভাসিয়ে পুরাতন বছরের গ্লানি মুছে নতুন বছরে নিজেদের পবিত্রতা কামনা করে। এছাড়া ফুলের মালা দিয়ে ঘরের প্রতিটি দরজা সাজানো হয়। ত্রিপুরা ও চাকমা সম্প্রদায় গতকাল শুক্রবার এ ফুল বিজু পালন করে। রাতে উড়ানো হয় হাজারো ফানুস বাতি। আজ শনিবার মূল বিজু এবং আগামীকাল রবিবার পহেলা বৈশাখ বা গজ্জাপয্যা পালন করবে। ঐদিন ঘরে ঘরে চলবে অতিথি আপ্যায়ন। ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের হারিবৈসু, বিযুমা, বিচিকাতাল। ফুল বিজু, মূল বিজু ও বিচিকাতাল নামে নিজস্ব আমেজে চাকমারা এ উৎসব পালন করে। ত্রিপুরা ভাষায় এ উৎসবকে বৈসু ও চাকমা ভাষায় বিজু বলা হয়। এদিকে, ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের বর্ষবরণ উৎসব বৈসু উপলক্ষে খাগড়াছড়িতে শোভাযাত্রা বের হয়। গতকাল শুক্রবার সকালে উপজেলা পরিষদ মাঠে শোভাযাত্রা উদ্বোধন করেন শরণার্থী পুর্নবাসন বিষয়ক টাস্কফোর্স চেয়ারম্যান কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা এমপি। শোভাযাত্রাটি শহরের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক প্রদক্ষিণ শেষে খাগড়াপুর মাঠে গিয়ে শেষ হয়। ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাকে শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করেন। এসময় সপ্তাহব্যাপী আয়োজিত বৈসু মেলার উদ্বোধন করেন খাগড়াছড়ি রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল হামিদুল হক। এ উপলক্ষে ত্রিপুরাদের ঐতিহ্যবাহী গড়াইয়া নৃত্যেরও আয়োজন করা হয়েছে।
অপরদিকে, আগামীকাল রবিবার মারমা সম্প্রদায়ের সাংগ্রাই উৎসবে ঐতিহ্যবাহী জলকেলি বা পানি খেলা এবং জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে বর্ষবরণ র্যালির আয়োজন করা হয়েছে। ত্রিপুরা, মারমা ও চাকমা এই তিন সম্প্রদায়ের উৎসবের নাম একত্র করে বৈসাবি শব্দটির উৎপত্তি। পাশিপাশি তঞ্চঙ্গ্যা, বম, খিয়াং, লুসাই, পাংখোয়া, ম্রো, খুমি, আসাম, চাক ও রাখাইনসহ ১৩টি ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী তাদের ভাষা-সংস্কৃতি ও অবস্থানকে বৈচিত্র্যময় করে তুলতে প্রতি বছর চৈত্রের শেষ দিন থেকে ‘বৈসাবি’ উৎসব পালন করে থাকে। বৈসাবি উৎসবের মধ্য দিয়ে পাহাড়ি-বাঙালির মধ্যে শান্তি-সম্প্রীতি ও ঐক্য আরো সুদৃঢ় হোক এই প্রত্যাশা সকলের।
এদিকে, রামগড় সংবাদদাতা জানান, ভোরে জলদেবীর উদ্দেশ্যে চেঙ্গী নদীতে ফুল দিয়ে দেবতার উদ্দেশ্যে প্রার্থনার মধ্য দিয়ে খাগড়াছড়িতে শুরু হয় চাকমা সম্প্রদায়ের বিজুর আনুষ্ঠানিকতা। গতকাল শুক্রবার ভোরের আলোয় ঐতিহ্যবাহী পোশাকে জেলা সদরের বটতলী এলাকায় চেঙ্গীতে ফুল দিতে ছুটে আসেন শহরের আশপাশের এলাকার চাকমা সম্প্রদায়ের মানুষেরা। পার্বত্য এলাকার সনাতন ধর্মাবলম্বী ত্রিপুরা উপজাতীয়রা তিনটি ধাপে নানা অনুষ্ঠান আয়োজনে উদযাপন করে বৈসু। চৈত্রসংক্রান্তির পূর্বদিন হারি বৈসু হিসাবে পালন করে তারা। ত্রিপুরা উপজাতীয়রা অনাগত দিনের সুখ শান্তি কামনায় সৃষ্টিকর্তার কাছে বিশেষ প্রার্থনা করে। নদী, মন্দির ও বিশেষ পবিত্র স্থানে বিধাতার উদ্দেশ্যে ফুল অর্পণ, ধুপ ও মঙ্গল প্রদীপ জ্বালানো হয়। গৃহ পালিত গরু মহিষকে গোসল করিয়ে গলায় ফুলের মালা পরিয়ে দেয়া হয়। একে অপরকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানায় আবাল বৃদ্ধ বণিতা।
পার্বত্য চট্টগ্রামের দ্বিতীয় বৃহৎ ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠী মারমাদের সাংগ্রাই হচ্ছে প্রধান উৎসব। সাংগ্রাইং শব্দের অর্থ বর্ষশেষ বর্ষশুরু। মারমাদের বিশ্বাস সমাজে উঁচু নীচু, ধনী দরিদ্র সকল ভেদাভেদ দূর করে মানুষে মানুষে সম্প্রীতির বন্ধন সৃষ্টি করে সাংগ্রাই। তাই তারা ধর্মীয় রীতি ও সামাজিক প্রথা এ দুয়ের সমন্বয়ে উৎসবটি পালন করে। চৈত্রের শেষ দিন ও বৈশাখের প্রথম দুদিন মিলে মোট তিনদিন উদযাপন করা হয় সাংগ্রাই। চৈত্রের শেষদিন কেয়াং (উপাসনালয়) ধুয়ে মুছে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা হয়। আনুষ্ঠানিকভাবে গোলাপ চন্দন জলে ধৌতকরণ করা হয় কেয়াংয়ের বৌদ্ধ মূর্তি। চৈত্রের শেষদিন সারা রাত জেগে মহিলারা নানা রকমের পিঠা তৈরি করে। নতুন বছরের প্রথমদিন ভোরে এসব পিঠার এক ভাগ দান করা হয় কেয়াংয়ে। সাংগ্রাইয়ের প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে জলকেলি। মারমা ভাষায় একে রিলংপোয়ে বলে। খোলা মাঠে জলাধার বসিয়ে কিশোর কিশোরী, তরুণ তরুণীরা মুখোমুখি দাঁড়িয়ে একে অন্যকে পানি ছুঁড়ে মেরে আনন্দ উপভোগ করে। এছাড়া সাংগ্রাই উপলক্ষে পাড়ায় পাড়ায় হাডুডু, রশি টানাটানি, বলী খেলা, গিলা খেলা ইত্যাদি ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা ও রাতে পালা গানের আয়োজন করা হয়।
চাকমা সম্প্রদায় ফুল বিজু, মূল বিজু ও গজ্জাপয্যা বিজু নামে তিনদিনব্যাপী উদযাপন করে বর্ষ বিদায় ও বরণ উৎসব। গতকাল শুক্রবার ফুল বিজুর দিনে চাকমা ছেলে মেয়েরা ভোর বেলায় ঘুম থেকে উঠে গোসল সেরে নানা রকমের ফুল সংগ্রহে বেরিয়ে পড়ে। সংগৃহীত ফুলের কিছু অংশ ঘর দোর সাজানোর কাজে ব্যবহার করা হয়। কেয়াংয়ে ভগবান বুদ্ধের উপাসনা শেষে ছেলে মেয়েরা ফুল নিয়ে চলে যায় নদী, ছড়া বা খাল পাড়ে। এখানে তৈরি করা অস্থায়ী ম-পে পূজা অর্চনা শেষে জলদেবীর উদ্দেশ্যে ফুল ভাসিয়ে দেয়া হয় নদী বা ছড়ার পানিতে।
বছরের শেষদিনটি (৩০ চৈত্র) হচ্ছে মূল বিজু। বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়ানো আর আপ্যায়নে কাটে মূল বিজু। মূল বিজুতে অতিথি আপ্যায়নের জন্য ফুল বিজুর রাতেই চাকমা মহিলারা রকমারী পিঠা তৈরি করে। খই ও নাড়–ও তৈরি করা হয়। মূল বিজুর দিন এসব পিঠা, খই, নাড়–র সাথে নানান পদের তরিতরকারি দিয়ে রান্না করা পাজন (পাঁচন) এবং নিজস্ব তৈরি মদ দিয়ে আপ্যায়ন করা হয় অতিথিদের। সন্ধ্যায় ঘরের দরজায়, আঙ্গিনায়, গোশালা ও হাঁস মুরগির ঘরের দরজায় মঙ্গল প্রদীপ জ্বালানো হয়। নববর্ষের প্রথম দিনকে গইজ্জাপয্যা বিজু বলা হয়। ফুল বিজু ও মূল বিজু পালনে পরিশ্রান্ত চাকমা জনগোষ্ঠী গইজ্জাপয্যা বিজুতে সারাদিন ঘরে বিছানায় গড়াগড়ি দিয়ে বিশ্রামে সময় কাটায়। ছোটরা বড়দের প্রণাম করে আর্শীবাদ নেয়।