বাংলাদেশে চতুর্থবারের মত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা। গতকাল সোমবার বিকেলে বঙ্গভবনের দরবার হলে প্রধানমন্ত্রীকে শপথ পড়ান রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। এ শপথের মধ্য দিয়েই শেখ হাসিনা চতুর্থ মেয়াদে বাংলাদেশের সরকার প্রধানের দায়িত্ব নিয়ে ইতিহাস গড়লেন। একই সঙ্গে টানা তৃতীয়বারের মত রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিলেন তিনি ও তার দল আওয়ামী লীগ। পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতের মধ্যদিয়ে শপথ অনুষ্ঠান শুরু হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথমে শপথ নেন প্রধানমন্ত্রীর পদের দায়িত্বের জন্য। পরে রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা রক্ষার শপথ নেন তিনি। একইভাবে শেখ হাসিনার নয়া ক্যাবিনেটের ২৪ জন মন্ত্রী, ১৯ জন প্রতিমন্ত্রী ও ৩ জন উপমন্ত্রী প্রথমে পদের ও পরে গোপনীয়তা রক্ষার শপথ নেন। মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম এই শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। অনাড়ম্বর এ শপথ অনুষ্ঠানে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, পদস্থ সামরিক বেসামরিক কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী, কূটনীতিক, নাগরিক সমাজের বিশিষ্ট প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
বঙ্গবভনে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়ে শেখ হাসিনা মঞ্চ থেকে নেমে আসার পরেই ফুল দিয়ে প্রথম তাঁকে শুভেচ্ছা জানান তারই ছোট বোন শেখ রেহানা। আবেগ আপ্লুুত হাসিনাও এ সময় অনুজার সঙ্গে আলিঙ্গনে আবদ্ধ হন।
রেওয়াজ ভেঙ্গে এবার একদিন আগেই গত রবিবার সচিবালয়ে সাংবাদিক ডেকে ৪৭ সদস্যের নতুন মন্ত্রিসভার সদস্যদের নাম এবং দফতর বণ্টনের কথা জানিয়ে দেন মন্ত্রিপরিষদের সচিব শফিউল আলম। বাংলাদেশে এরআগে কখনও এভাবে ফলাও করে মন্ত্রীদের নাম ও দপ্তর বণ্টনের ঘোষণা আসেনি। তার বাইরে, এবারই প্রথম শেখ হাসিনা তার মিত্র ১৪ দলের রাজনৈতিক জোটের কোনও সদস্যকে নতুন মন্ত্রিসভায় জায়গা দেননি। একই সঙ্গে বাদ দেওয়া হয়েছে তার বিদায়ী মন্ত্রিসভার ৩৭ জন সদস্যকেও। গত রবিবার নতুন ক্যাবিনেটের নাম ঘোষণার পর থেকেই গোটা দেশে চলছে এ বিষয়ে নানা আলোচনা।
এ সম্পর্কে আওয়ামী লীগের জোটসঙ্গী দলের একজন নেতা বলেছেন, মন্ত্রিসভা গড়া নিয়ে তাদের সঙ্গে আগে আলোচনা করা হয়নি। তারা আশা করছেন, এখনও সময় রয়েছে আলোচনার মাধ্যমে একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর। নতুন যে মন্ত্রীরা গতকাল শপথ নিলেন তার মধ্যে ২৫টি মন্ত্রণালয়ের মধ্যে ১৮টিতেই পরিবর্তন এসেছে। দেখা গেছে, জোটসঙ্গী ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন, জাসদের হাসানুল হক ইনু এবং জাতীয় পার্টি (জেপি) এর আনোয়ার হোসেন মঞ্জু মন্ত্রিত্ব হারিয়েছেন।
বিগত সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রী ও ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা রাশেদ খান মেনন মনে করেন এই মন্ত্রিসভা নিয়ে তাদের সাথে আগে আলোচনা করা হয়নি। তিনি বলেন, এটি রীতিমত অস্বাভাবিক মনে হয়। মেননের কথায়- ‘এটা একটা সাহসী পদক্ষেপ কোনও সন্দেহ নেই। তবে, এখানে যে অসুবিধাটা হল, তা হচ্ছে এটা পুরোপুরি আওয়ামী লীগের মন্ত্রিসভা, জোটের এতে অংশিদারিত্ব রইল না।’ রাশেদ খান মেনন আরও বলেন, ‘কথা ছিল আন্দোলন, নির্বাচন আর সরকার একসঙ্গে হবে। কিন্তু শরিকদের বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। এ বিষয়টি নিয়ে আমরা আলোচনা করবো। হয়তো, ১৪ দলের সমন্বয়কের কাছে ব্যাখ্যাও চাওয়া হবে, কেন মন্ত্রিসভায় রাখা হলো না।’
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদের সাধারণ সম্পাদক এবং ফেনী-১ আসনের সাংসদ শিরিন আখতার মনে করেন, নেতাকর্মীদের মধ্যে একটা প্রতিক্রিয়া আছে। তবে, সবার উপরে তারা রাজনীতিকে প্রাধান্য দিচ্ছেন।
বঙ্গভবনে গতকাল শপথ অনুষ্ঠান শেষে নতুন মন্ত্রিসভায় জোটসঙ্গীদের সম্পর্কে জানতে চাওয়া হলে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘শরীকরা আমাদের সঙ্গেই রয়েছেন। মন্ত্রী না হলে তারা আমাদের সঙ্গে থাকবেন না, এমন নয়। ভবিষ্যতের মন্ত্রিসভা রিশাফলিং হবে। সময়ে সময়ে চাহিদা অনুযায়ী পরিবর্তনও হতে পারে। জোটসঙ্গীরা এখন নেই, ভবিষ্যতে আসবে না এমন নয়।’ মন্ত্রিসভার আকার শিগগিরই বড় করা হলে ১৪ দলের শরিকরা তাতে যোগ দিবে কিনা- জবাবে মেনন বলেন, ‘সেটা তো অপমান করা। আমার মনে হয় এক দেড় বছরের মধ্যে মন্ত্রিসভা পুনর্গঠন করা হবে না।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৪৭ সদস্যের এই মন্ত্রিসভার ২৭ জনই নতুন। অর্থাৎ তারা প্রথমবারের মত মন্ত্রিসভায় যুক্ত হলেন। অন্যদিকে, দীর্ঘদিন মন্ত্রিত্বের দায়িত্ব পালন করে আসা আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও উপদেষ্টা পরিষদের অনেক সদস্যেরও জায়গা হয়নি নতুন এই মন্ত্রিসভায়। শুধু তাই নয়, আওয়ামী লীগের বর্তমান কেন্দ্রীয় কমিটির খুব অল্পসংখ্যক নেতাকে মন্ত্রিসভার সদস্য করা হয়েছে। অনেকের মতে, দল হিসেবে আওয়ামী লীগকে সরকার থেকে যতটা সম্ভব দূরে রাখতেই প্রধানমন্ত্রী এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকতে পারেন।
মন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন যাঁরা : গতকাল বঙ্গবভনে প্রধানমন্ত্রীর পরেই রাষ্ট্রপতির কাছে একাদশ জাতীয় সংসদের পূর্ণ মন্ত্রী হিসেবে ২৪ জন শপথ নেন। রীতি অনুযায়ী তারাও প্রথমে পদের এবং পরে গোপনীয়তার শপথ নেন।
শপথ নেওয়া মন্ত্রীরা হলেন- আ ক ম মোজাম্মেল হক (মুক্তিযুদ্ধ), ওবায়দুল কাদের (সড়ক পরিবহন ও সেতু), ড. আব্দুর রাজ্জাক (কৃষিমন্ত্রী), আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল (স্বরাষ্ট্র), ড. হাছান মাহমুদ (তথ্য), আনিসুল হক (আইন), আ হ ম মুস্তফা কামাল (অর্থ), তাজুল ইসলাম (এলজিআরডি), ডা. দীপু মনি (শিক্ষা), একেএম আব্দুল মোনেম (পররাষ্ট্র), এমএ মান্নান (পরিকল্পনা), নুরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ূন (শিল্প), গোলাম দস্তগীর গাজী (বস্ত্র ও পাট), জাহিদ মালেক স্বপন (স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ), সাধন চন্দ্র মজুমদার (খাদ্য), টিপু মুনশি (বাণিজ্য), নুরুজ্জামান আহমেদ (সমাজকল্যাণ), শ ম রেজাউল করিম (গৃহায়ন ও গণপূর্ত), মো. শাহাব উদ্দিন (পরিবেশ, বন ও জলবায়ু), বীর বাহাদুর উশৈ সিং (পার্বত্য), সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাভেদ (ভূমিমন্ত্রী), মো. নুরুল ইসলাম সুজন (রেলপথ), স্থপতি ইয়াফেস ওসমান (বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি) ও মোস্তফা জব্বার (ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য প্রযুক্তি)।
প্রতিমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন যাঁরা : মন্ত্রীদের পর প্রতিমন্ত্রী হিসেবে রাষ্ট্রপতির কাছে শপথ নেন ১৯ জন। প্রথমে তারা পদের এবং পরে গোপনীয়তার শপথ নেন। এই ১৯ প্রতিমন্ত্রী হলেন- কামাল আহমেদ মজুমদার (শিল্প), ইমরান আহমেদ (প্রবাসী), জাহিদ আহসান রাসেল (যুব ও ক্রীড়া), নসরুল হামিদ (বিদ্যুৎ), আশরাফ আলী খান খসরু (মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ), বেগম মন্নুজান সুফিয়ান (শ্রম ও কর্মসংস্থান), খালিদ মাহমুদ চৌধুরী (নৌ-পরিবহন), জাকির হোসেন (প্রাথমিক ও গণশিক্ষা), শাহরিয়ার আলম (পররাষ্ট্র), জুনাইদ আহমেদ পলক (তথ্য ও যোগাযোগ), ফরহাদ হোসেন (জনপ্রশাসন), স্বপন ভট্টাচার্য (স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়), জাহিদ ফারুক (পানি সম্পদ), মো. মুরাদ হোসেন (স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ), শরীফ আহমেদ (সমাজকল্যাণ), কে এম খালিদ (সংস্কৃতি বিষয়ক), ডা. এনামুর রহমান (দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা), মো. মাহবুব আলী (বেসামরিক বিমান) ও শেখ মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ (ধর্ম বিষয়ক)।
উপমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিলেন যাঁরা : প্রতিমন্ত্রীদের পর উপমন্ত্রী হিসেবে বেগম হাবিবুন্নাহার (বন পরিবেশ ও জলবায়ু), একেএম এনামুল হক শামীম (পানিসম্পদ) ও মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলকে (শিক্ষা) শপথ নেন।
উল্লেখ্য, গত ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ পেয়েছে ২৫৭টি আসন। জাতীয় পার্টি পেয়েছে ২২টি আসন। বিএনপি পেয়েছে ৫টি আসন। বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি পেয়েছে ৩টি আসন, গণফোরাম ২টি, বিকল্প ধারা বাংলাদেশ ২টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) ২টি, বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন ১টি, জাতীয় পার্টি (জেপি) ১টি এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ৩টি আসনে জয়ী হয়েছেন।