‘দোলারা কোথায় যাবে?’

প্রিয়াংকা রাণী দেবী,সীতাকুণ্ড : নবম শ্রেণি পর্যন্ত মাদ্রাসায় পড়াশুনা করার পর আর বেশি দূর যেতে পারেননি দোলা। পরিবারের স্বজন থেকে শুরু করে সমবয়সীদের কাছে ঘৃণার পাত্র হয়ে ওঠে দোলা। মানুষের যাত্রা পথে অশুভও নাকি বয়ে আনে দোলা। দোলারা মোটজনসংখ্যার একটি ক্ষুদ্র অংশ হলেও আবহমানকাল থেকে এ জনগোষ্ঠী অবহেলিত ও অনগ্রসর গোষ্ঠী হিসেবে পরিচিত। সমাজে বৈষম্যমূলকআচরণের শিকার হচেছ তারা।  তাহলে দোলারা কোথায় যাবে? ঘর থেকে বের হবে না! তারাওতো মানুষ। দোলারাও চায় তাদের সঙ্গে মর্যাদা দিয়ে কথা বলুক। ঘৃণার চোখে না দেখুক। সমাজে দশজনের মত করে চলুক। এই অবস্থায় সরকারে উচিৎ তাদের পাশে থাকা। সরকারি বিভিন্ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। যাতে আর সর্দান্নীর সহযোগিতা না লাগে। কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে আলোর মুখ দেখে। সমাজের বোঝা নয় দেশের শক্তি হিসেবে গড়ে তুলতে।

রংপুর পীরগঞ্জ থানার চৌদ্দগ্রামের ছাদেক আলী ও জোছনা বেগমের ঘরে জন্ম হয় দোলার। বাবা জুয়া ও নেশা করায় আর্থিক অনটন লেগেই থাকতো যার প্রভাব পড়ে দোলার উপরও। দোলার আরও দুইবোন রয়েছে। মাদ্রাসায় প্রাইমারী গন্ডি পেরুলেও মাধ্যমিক সার্টিফিকে তার আর অর্জন করা সম্ভব হয়নি। সমবয়সীদের কাছ থেকে টিটকারী, অপমান পেয়ে প্রায় মন খারাপ করে রাখতো। একপর্যায়ে মাদ্রাসা থেকে বের হয়ে চলে আসে সে। মাদ্রাসা থেকে চলে আসায় ওই দিন রাতই তাকে মারধর করে পরিবারের স্বজনরা। পরে গভীররাতেই বাড়ি থেকে পালিয়ে যায় দোলা।

বাড়ি থেকে প্রথমে সিলেটে চলে যায় সে। সেখানে বাবুর্চির কাজ নেয়। সেখানে তিন চারদিন পর শুরু হয় সমবয়সী ছেলের উৎপাত। রাতে ঘুমাতে গেলে ছেলেরা সমস্যা করতে থাকে। নির্যাতনের শিকার হতে হয় রেস্টুরেন্টেও। এভাবে চলতে থাকলে সহ্য করতে না পেরে চাকরি ছেড়ে চলে আসে। পরে চলে যায় ঢাকায়। সেখানে সর্দান্নীর (হিজরাদের নেতা) কাছে থাকে। সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে সর্দান্নীর কাছে ফিরলে মাত্র একবেলা ভাত দিতো। টাকা ছাড়া সর্দান্নী কিছুই বুঝে না। এই অবস্থায় সেখানে অফিসে যোগাযোগ করে অভিযোগও করেন। পরে সেখানে টিকতে না পেরে চলে আসেন সীতাকুণ্ডে।

প্রতিবেকের সঙ্গে আলাপচারিতায় দোলা বলেন, ‘দুই চার দশজনে যেভাবে চলছে আমি চাই আমরাও যাতে সেভাবে চলতে পারি’। আমরাওতো মানুষ। দশজনের মত করে চলতে না পারি। সবাই ঘৃণার চোখে দেখে। তাহলে আমরা কোথায় যাবো। সরকারে উচিৎ আমাদের দায়িত্ব নেওয়া। আমাদের পাশে থাকা’।

এখন পর্যন্ত সরকারি কোন সহযোগিতা পাননি জানান দোলা। সীতাকুণ্ড উপজেলা প্রশাসনের কাছে তার অনুরোধ সরকারিভাবে যাতে তাদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে দেয়। তারা যাতে আর্থিক ভাবে স্বাবলম্বী হতে পারবে। দোলার প্রত্যাশা ‘আমরা কেন সমাজের বাইরে থাকব।আমরা চাই স্বাবলম্বী হয়ে সমাজের মধ্যে বাকী সবার মত করে বেঁচে থাকতে।

হেয় প্রতিপন্ন যাদের কাছে হতে হয় তাদের উদ্দেশ্যে দোলা বলেন, প্রায় সময় রিক্সায় উঠলে সেটা যদি সকাল বেলা হয় তাহরে এক রিক্সাওয়ালা অপরজনকে বলেন, ‘ওদেরকে নিছনা’ ওদেরকে নিলে যাত্রা শুভ হইব না’ রিক্সাওয়ালার ঐ কথা শোনার পর আমাকে আরা রিক্সায় উঠতে দেওয়া হয়নি। প্রতিবাদও করতে পারেননি। এভাবে তিরস্কার কথা শুনতে হয় বলে জানান দোলা।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা জানতে চাওয়া হলে দোলা বলেন, বাড়ি ঘরে এখন যাওয়া হয় না। এখানে আমার নানগুরু আছে। আমি যদি মারা যাই তা লে আমার নানগুরু সবকিছু দেখবে। এখন আমার বাপ-মা সবকিছু আমার নানগুরু। দুই বোন । ভাই নাই।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ১০ টিবিশেষ উদ্যোগের মধ্যে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি একটি অন্যতম উদ্যোগ। আর সামাজিকনিরাপত্তা কর্মসূচীর র আওতায় বিভিন্ন ভাতার মধ্যে হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবন মানউন্নয়ন কর্মসূচি উল্লেখযোগ্য।

বাংলাদেশ সরকারের সমাজকল্যাণ মন্ত্রণায়লের অধীনে হিজড়া জনগোষ্ঠী দেশের মোটজনসংখ্যার একটি ক্ষুদ্র অংশ হলেও আবহমানকাল থেকে এ জনগোষ্ঠী অবহেলিত ও অনগ্রসর গোষ্ঠীহিসেবেপরিচিত। সমাজে বৈষম্যমূলকআচরণের শিকার এ জনগোষ্ঠীর পারিবারিক, আর্থসামাজিক, শিক্ষাব্যবস্থা, বাসস্থান, স্বাস্থ্যগত উন্নয়ন এবং সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ সর্বোপরি তাদেরকে সমাজের মূলশ্রোতধারায় এনে দেশের সার্বিকউন্নয়নে তাদেরকে সম্পৃক্তকরণের লক্ষ্যে সরকার এ কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।

সীতাকুণ্ডের হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমানউন্নয়নকর্মসূচি গ্রহণ করেছে সরকার। তারা কিকি সরকারী সুবিধা পাচ্ছে এবং তাদের জীবনমান উন্নয়নে সরকারী পদক্ষেপ সম্পর্কে বলেন উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা লুৎফুন নেছা বেগম বলেন, হিজরাদের ঘরের কোণে নয় তাদেরকে অবহেলা করে নয় তাদেরকে মূল শ্রোতধারায় তাদেরকে নিয়ে আসার জন্য বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ চালু করেছেন ভাতা চালু করেছেন সমাজসেবা অধিদপ্তর। উল্লেখ করতে চাচ্ছি তারা মাসে ৬০০ টাকা করে ভাতা পেয়ে থাকেন। এভাবে কিন্তু হিজরাদের মূলশ্রোতধারায় নিয়ে আসার জন্য চেষ্টা করছি। এবং জরিপে গত ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে ২জন রয়েছে এবং২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে ৩ জনের লিস্ট আমরা হাতে পেয়েছি। অর্থাৎ ৫জনকে তালিকাভূক্ত করেছি।বাংলাদেশের ৬৪টি জেলার প্রায় প্রত্যেকটি জেলায় হিজরাদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। এবং চট্টগ্রাম জেলার যে সমাজসেবা কার্যালয় রয়েছে সেখানে ৫০ দিন ব্যাপী প্রশিক্ষণ কর্মসূচি ইতিমধ্যেই পরিচালিত হয়েছে । সেখানে হিজরাদেরকে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ যেমন ড্রাইভিং, বেকারি, পার্লারের কার্যাবলী প্রশিক্ষণ তাদের দেওয়া হচ্ছে যাতে তারা কাজের মাধ্যমে অর্থনৈতিক স্বাবলম্বী হতে পারে। এসব কাজের সঙ্গে তাদের অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও ঋণ এই বিষয়গুলো ধিরে ধিরে সংযুক্ত হচ্ছে।

হিজড়াভাতার গুরুত্বসম্পর্কে তিনি আরও জানান, ভাতা তাদের জন্য প্রয়োজন। তবে একজন মানুষকে সাহায্য করার জন্য একটি সহায়তা মাত্র। মানুষকে সহায়তা করার জন্যই মূলত আমরা মানুষকে এই সহায়তাগুলো দিয়ে থাকি। হিজরা যারা তারা হীনমনতায় ভুগে। পরিবার থেকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। সেই অবস্থা থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য এ ভাতা হচ্ছে একটি সহায়ক অবলম্বন মাত্র। পাশাপাশি প্রশিক্ষণ এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতার জন্য ঋণ প্রদান এগুলোর মাধ্যমে হিজরারা মূলশ্রোতধারায় ফিরে আসবে এই লক্ষ্য রেখে আমরা আমাদের কাজ এগিয়ে নিচ্ছি।

আলোকিত সাতকানিয়া/এইচএম