একাদশ সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয় নিয়ে যারা প্রশ্ন তুলেছেন, পরিসংখ্যান দিয়ে তাদের জবাব দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীপুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়। তিনি বলেছেন, এত বড় ব্যবধানের জয় কখনোই কারচুপির মাধ্যমে আদায় করা সম্ভব না।
গত ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনে রেকর্ড পরিমাণ ভোট পেয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে জয়ী হয়েছে আওয়ামী লীগ। বিপরীতে ভরাডুবি ঘটেছে বিএনপির। বেশিরভাগ আসনে তাদের প্রার্থী জামানত হারিয়েছে।
বিএনপি নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ‘ভোট ডাকাতি’র অভিযোগ তুলে বলেছে, প্রশাসন ও পুলিশের সহায়তায় ব্যালট বাক্স আগেই ভরে রাখা হয়েছিল, আর তাদের ভোটারদের কেন্দ্রেই যেতে দেওয়া হয়নি। একই অভিযোগ তুলে নতুন করে নির্বাচনের দাবি তুলেছে বাম গণতান্ত্রিক জোটও।
এই অভিযোগের প্রেক্ষাপটে শনিবার নিজের ফেসবুক পাতায় এক পোস্টে জয় আওয়ামী লীগের বিজয় ও ঐক্যফ্রন্টের পরাজয়ের কারণ তুলে ধরার পাশাপাশি যারা নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, তাদেরও সমালোচনা করেন।
জয় লিখেছেন, নির্বাচনে ব্যালটের মাধ্যমে বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টকে বাংলাদেশের মানুষ পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করেছে। তাই তারা এখন তাদের ‘বিদেশি প্রভুদের’ কাছে নালিশ করছে ও সাহায্য চাইছে।
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যোগাযোগ ও লবিং এর মাধ্যমে তারা প্রমাণ করতে চাইছে যে নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে, যা পরিসংখ্যান মোতাবেক একেবারেই অসম্ভব।
জয়ের পরিসংখ্যান
জয় লিখেছেন, আওয়ামী লীগ বিএনপি থেকে প্রায় ৪ কোটি ৯০ লাখ বেশি ভোট পেয়েছে। এত বড় ব্যবধানের জয় কখনোই কারচুপির মাধ্যমে আদায় করা সম্ভব না।
ভোট কেন্দ্রে বিএনপিকে যেতে বাধা দেওয়ার অভিযোগের জবাবে তিনি বলেন, তারা বলছে ভয়-ভীতির কথা। কিন্তু যদি আমরা ধরেও নেই আওয়ামী লীগের বাইরের সকল ভোট বিএনপি-জামায়াত এর পক্ষেই যেত, তাহলেও ২ কোটি ২০ লক্ষ ভোটের ব্যবধান থাকতো বিএনপি আর আওয়ামী লীগের মধ্যে। খবর বিডিনিউজের
ভোটের হার নিয়ে জয়ে বলেন, তাদের প্রথম অভিযোগ, ভোটার সংখ্যা ছিল অত্যধিক, তার মানে ভুয়া ভোট দেওয়া হয়েছে। এবার ভোট দেওয়ার হার ছিল ৮০ শতাংশ, যা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ইতিহাসে সর্বোচ্চ নয়। ২০০৮ সালের ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারের’ অধীনে নির্বাচনে ভোট দেওয়ার হার ছিল ৮৭ শতাংশ, যা এখন পর্যন্ত রেকর্ড। সেই নির্বাচনটিতেও আওয়ামী লীগ ৪৭ শতাংশ ভোট পেয়ে ব্যাপক ব্যবধানে জয় পেয়েছিলো।
২০০১ সালে ভোট দেওয়ার হার ছিল ৭৫.৬ শতাংশ আর ১৯৯৬ সালে ছিল ৭৫ শতাংশ। ওই দুইটি নির্বাচনের তুলনায় এবার ভোট দেওয়ার হার সামান্য বেশি ছিল। কারণ এক দশকে এটাই ছিল প্রথম অংশগ্রহণমূলক জাতীয় নির্বাচন।
তথ্য নিয়ে অপপ্রচার চলছে অভিযোগ করে জয় লিখেছেন, দ্বিতীয় অপপ্রচার হয়ে আওয়ামী লীগ নাকি এবার ৯০ শতাংশ ভোট পেয়েছে। এই কথাটি পুরোপুরি মিথ্যা। আওয়ামী লীগ ভোট পেয়েছে ৭২ শতাংশ। মহাজোটের অন্যান্য শরিকরা পেয়েছে ৫ শতাংশের কম ভোট। এই ৭২ শতাংশও আওয়ামী লীগের এর জন্য সর্বোচ্চ না।
আগের নির্বাচনের চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেন, ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ৭৩.২ শতাংশ ভোট। সেইবার স্বাধীনতা ও মুক্তি সংগ্রামে নেতৃত্ব দেয়ার কারণে আওয়ামী লীগ বিশাল বিজয় পেয়েছিল।
এবার নির্বাচনের আগে নিজের চালানোর জরিপেও জয় আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ জয়ের আভাস দিয়েছিলেন, তবে তার জরিপের চেয়ে বেশি আসনে জিতেছে আওয়ামী লীগ।
বিএনপি নেতারা দাবি করছেন, নির্বাচনে কারচুপির প্রমাণ ওই জরিপ, যাতে ফল আগেই ঠিক করে রাখা হয়েছিল।
জয় লিখেছেন, ২০১৩ সাল থেকেই আওয়ামী লীগের জন্য আমি জনমত জরিপ করাই। হার্ভার্ডে থাকতে আমি জনমত জরিপের উপর পড়াশুনা করি। জরিপ করতে আমরা যাদের ব্যবহার করি, তাদের বাছাই করার আগে আমি নিজে একাধিক গবেষণা সংগঠনের সাথে বসে আলাপ করি।
ভুয়া জরিপ করে নিজেদের জনপ্রিয়তা দেখানোর কাজ আমরা করি না, কারণ আমাদের জন্যই সঠিক তথ্যটি পাওয়া খুবই জরুরি। আমরা জানতে চেষ্টা করি নির্বাচনী লড়াইয়ে আমাদের অবস্থান ও সক্ষমতা, তাই জরিপের ব্যাপারে আমরা খুবই সতর্ক থাকি।
জয় লিখেছেন, নির্বাচনের দুই সপ্তাহ আগে আমাদের জরিপ থেকে আমরা জানতে পারি আওয়ামী লীগ পাবে ৫৭ থেকে ৬৩ শতাংশ ভোট আর বিএনপি পাবে ১৯ থেকে ২৫ শতাংশ ভোট। তাহলে আমরা ৭২ শতাংশ ভোট কিভাবে পেলাম?
আমাদের জরিপের জন্য স্যাম্পল নেওয়া হয় ৩০০ আসন থেকে, অর্থাৎ ১০ কোটি ৪০ লক্ষ নিবন্ধিত ভোটারের মধ্যে থেকে। কিন্তু ভোট দেওয়ার হার কখনোই ১০০ শতাংশ হয় না, আর ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচন হয়েছিল ২৯৮টি আসনে। ২৯৮টি আসনে ১০ কোটি ৩৫ লক্ষ নিবন্ধিত ভোটারের মধ্যে ৮০ শতাংশ ভোট দিয়েছেন অর্থাৎ ৮ কোটি ২৮ লক্ষ। আওয়ামী লীগ পেয়েছে প্রায় ৬ কোটি ভোট। ১০ কোটি ৩৫ লক্ষ ভোটারের মধ্যে ৬ কোটি মানে ৫৮ শতাংশ। অর্থাৎ, আমাদের জরিপের সাথে এই বিষয়টি মিলে যায়।
আওয়ামী লীগের জয়ের কারণ
এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভোট বাড়ার পেছনে দুটি সুনির্দিষ্ট কারণ থাকার কথা বলেন জয়।
এর প্রথমটি গত ১০ বছরে মানুষের অর্থনৈতিক ও জীবনমানের উন্নতি। দ্বিতীয়টি সরকারের সাফল্য মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া।
জয় বলেন, আওয়ামী লীগ আমলে মানুষের জীবনমানের উন্নতি হয়েছে যে কোনো সময়ের থেকে বেশি। আমরা নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ হয়েছি, মাথাপিছু আয় প্রায় তিন গুণ বেড়েছে, দারিদ্র্যের হার অর্ধেক করা হয়েছে, মোটামুটি সবাই এখন শিক্ষার সুযোগ, স্বাস্থ্যসেবা ও বিদ্যুতের সুবিধা পায়ে।
আমাদের সুশীল সমাজ সবসময়ই বলার চেষ্টা করে, বাংলাদেশের ভোটাররা নাকি পরিবর্তন চায়। এইসব ঢালাও কথাবার্তা, যার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। এ থেকেই বোঝা যায় আসলে তারা কতটা জনসম্পৃক্ততাহীন।
প্রচারের বিষয়ে তিনি বলেন, আমাদের নির্বাচনী প্রচার কিন্তু গত বছর শুরু হয়নি। আমরা ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর থেকে আমাদের প্রচারণা শুরু করে দিয়েছিলাম। জনগণের কাছে আমাদের উন্নয়নের বার্তা পৌঁছে দেওয়ার কোনো সুযোগই হাতছাড়া করিনি। আমরা তাদেরকে বুঝিয়েছি, যা উন্নয়ন ও অগ্রগতি হয়ে তা আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার কারণেই হয়ে।
নাশকতার আন্দোলনের কারণে বিএনপি জনসমর্থন হারাতে শুরু করার পর দুর্নীতির মামলায় খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের দন্ড তা তলানীতে নিয়ে ঠেকায় বলে মনে করেন জয়।
বিএনপির চেয়ারপার্সন দুর্নীতির দায়ে দন্ডিত হয়ে জেলে আছেন। তাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সনও দন্ডিত আসামি, আছেন দেশের বাইরে পালিয়ে। তাদের সংগঠনের অবস্থা করুণ। তার থেকেও বড় আরেকটি কারণ আছে যা আমাদের সুশীল সমাজ সহজে বলতে চায় না।
জনমত জরিপগুলো থেকে খেয়াল করেছি যে বিএনপি ২০১৩ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত যে অগ্নিসন্ত্রাস চালায়, তার পর থেকেই তাদের জনপ্রিয়তায় ব্যাপক ধস নামে। পেট্রল বোমা সন্ত্রাসের আগে জরিপগুলোতে বিএনপি আওয়ামী লীগ থেকে জনপ্রিয়তায় ১০ শতাংশ পিছিয়ে থাকতো। কিন্তু রাজনীতির নামের সন্ত্রাসবাদের কারণে তাদের সাথে আওয়ামী লীগের ব্যবধান ৩০ শংতাংশ হয়ে যায়, আর তারপর থেকেই বাড়তেই থাকে।
বিএনপির প্রচারণার অভাব ও মনোনয়ন প্রক্রিয়াও এতে প্রভাব ফেলেছে বলে জয়ের পর্যবেক্ষণ।
নির্বাচনের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত তাদের সমর্থকদের তারা ইঙ্গিত দেয় যে তারা নির্বাচন থেকে সরে আসবে। আপনি যদি মনে করেন আপনার দল নির্বাচনেই আসবে না, তাহলে কি আপনি ভোট দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হবেন? এই কারণে তাদের নিজেদের সমর্থকদেরও ভোট দেওয়ার হার কম ছিল, যার ফলশ্রুতিতে তারা ভোট পায়ও কম।
জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নেতা কামাল হোসেন সম্পর্কে জয় লিখেছেন, কামাল হোসেন নিজে নির্বাচনই করেননি। কারণ উনি জানতেন উনি কোনো আসন থেকেই জিততে পারবেন না।
কিন্তু তারা আমাদের কিছুটা অবাকও করেছেন। ভোটের লড়াইয়ে প্রথমবারের মতো কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন গণফোরাম একটি নয়, দুইটি আসন থেকে জয়লাভ করে। কারচুপি যদি হতই, তাহলে যে দল আগে কোনো নির্বাচনেই কোনো আসন পায়নি, তারা কীভাবে দুটি আসনে জিতে?