জীবনের নানা রং ভালোভাবে প্রতিফলিত হয় ভালো সিনেমায়-আজাদী সম্পাদক

উৎসবমুখর পরিবেশে শেষ হয়েছে দুই দিনব্যাপী ৪র্থ চিটাগং শর্ট ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল। উৎসবের শেষ দিনে গতকাল ছিল চলচ্চিত্র প্রদর্শনী এবং পুরস্কার বিতরণ। প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ‘নকশা’ এবং স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র দৈনিক আজাদীর সার্বিক সহযোগিতায় তরুণ চলচ্চিত্রকারদের সংগঠন চিটাগং শর্ট এ উৎসবের আয়োজন করে। গতকাল সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের বঙ্গবন্ধু কনফারেন্স হলে ছিল পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক। এর আগে সকাল সোয়া দশটায় একই হলে উৎসবের উদ্বোধন করেন দৈনিক আজাদীর পরিচালনা সম্পাদক ওয়াহিদ মালেক। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন চিটাগং শর্টের প্রতিষ্ঠাতা ইসমাইল চৌধুরী।
পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক বলেন, মানুষের জীবনে অনেক উত্থান-পতন, দুঃখ-দুর্দশা এবং ভালোলাগা থাকে। সেগুলোকে ভালোভাবে পর্দায় প্রতিফলিত করতে পারে একটি ভাল সিনেমা।
দৈনিক আজাদী সম্পাদক খারাপ সিনেমাকে ‘ছি! নামা’ বলে অভিহিত করেন। তিনি তরুণ নির্মাতাদের ‘ছি! নামা’ নয়, সিনেমা নির্মাণের আহ্বান জানান। শর্ট ফিল্ম সম্পর্কে তিনি বলেন, জীবনে এখন সবকিছুই শর্ট হয়ে আসছে। যেমন একসময় ক্রিকেট ছিল পাঁচ দিনের খেলা। ক্রমান্বয়ে সেটা হয়ে গেল ওয়ান ডে এবং টি-টুয়েন্টি। এখন সবচেয়ে বেশি লোক দেখে টি-টুয়েন্টি। একইভাবে এমন একটা দিন আসবে যখন লোকজন শর্ট ফিল্ম দেখার জন্য ভিড় করবে।
ভারতীয় ‘শোলে’ ছবির দুটি সংলাপ তথা, ‘কিতনা আদমী থে’ এবং ‘জো ডর গেয়া ওহ মর গেয়া’ উদ্ধৃতি করে এম এ মালেক বলেন, আমরা ভয় পাওয়ার জন্য কেউ আসিনি। আমরা মরতেও আসিনি। আমরা জীবনটাকে উপভোগ করতে এসেছি। এই উপভোগের জায়গায় শর্ট ফিল্মের গুরুত্ব তুলে ধরেন তিনি।
এদিকে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দৈনিক আজাদীর পরিচালনা সম্পাদক ওয়াহিদ মালেক বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র বিগত সময়ের চেয়েও ভাল অবস্থানে আছে। এখন মানুষ হলমুখী। এটাই প্রমাণ করে চলচ্চিত্রের প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ছে। আমাদের জন্য অনেক বড় একটা পাওয়া। চলচ্চিত্রের প্রতি মানুষকে আকৃষ্ট করতে তরুণ নির্মাতারা ভূমিকা রাখছেন উল্লেখ করে
তিনি বলেন, তারা অনেক কষ্ট করছেন।
এসময় শর্ট ফিল্ম নির্মাণে কাজ করায় চিটাগং শর্টের প্রতিষ্ঠাতা ইসমাইল চৌধুরীর প্রশংসা করেন ওয়াহিদ মালেক। একই সঙ্গে চিটাগং শর্টের জন্মলগ্ন থেকেই দৈনিক আজাদী পাশে আছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি। তিনি বলেন, দৈনিক আজাদী চট্টগ্রামের পত্রিকা। চট্টগ্রামের যে কোন ভাল এবং মহৎ কাজের সঙ্গেই আজাদী থাকার চেষ্টা করে। ভবিষ্যতেও ভাল এবং মহৎ কাজের পাশে থাকবে আজাদী। উৎসবের জুরি বোর্ডের প্রধান ও বিটিভি চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক মহাব্যবস্থাপক নির্মাতা জ্যঁ-নেসার ওসমান চলচ্চিত্র নির্মাণ ব্যয়বহুল উল্লেখ করে এ খাতে সমাজের বিত্তশালীদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, চলচ্চিত্র গল্প লেখার মত না। এখানে টাকা লাগে। এখানে স্বচ্ছলদের সহযোগিতা করতে হবে। চলচ্চিত্র নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে।
তরুণ চলচ্চিত্র পরিচালক রায়হান রাফী বলেন, চট্টগ্রাম আমার প্রাণের শহর। যতবার আসি ভাল লাগে। চিটাগং শর্টের প্রশংসা করে তিনি বলেন, আমার স্বপ্ন ছিল। কিন্তু সেগুলো যেখানে সেখানে বলতে পারতাম না। তাছাড়া আগে এমন কিছু ছিলাম না, কেউ দাঁড় করিয়ে বলবে, ‘তুমি তোমার স্বপ্নের কথা বল’। একটা জায়গা ছিল, যেখানে এসে আমি বলতে পারতাম। ওটা আমার জীবনে অনেক কাজ দিয়েছে। এজন্য চিটাগং শর্টের সঙ্গে আমি সারাজীবন থাকব। তিনি আরো বলেন, বাংলা চলচ্চিত্র আস্তে আস্তে এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা ভাল চলচ্চিত্র নির্মাণের চেষ্টা করছি। তিনি নবীনদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে বলেন, শর্ট ফিল্ম বানান। আস্তে আস্তে দীর্ঘ চলচ্চিত্র বানাবেন। আপনাদের হাতেই দেশ।
উৎসবের জুরি মেম্বার ও নির্মাতা শাহজাহান শামীম বলেন, শর্ট ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল মেধাবীদের খুঁজে আনে। প্রতিটি শহরে চিটাগং শর্টের উদ্যোগের মত আয়োজন হলে আরো অনেক মেধাবী নিমার্তাদের পাওয়া যেত। তিনি বাংলাদেশের চলচ্চিত্র জগতকে বাঁচিয়ে রাখতে সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান। চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী এ কে এম ফজলুল্লাহ বলেন, বাংলাদেশের চলচ্চিত্র নিয়ে আমি আশাবাদী।
সিইউজের সভাপতি চলচ্চিত্র সমালোচক কবি নাজিমুদ্দীন শ্যামল বলেন, সিনেমা একটি স্বপ্ন। অনেকগুলো জীবনের শিল্পিত রূপ হয়ে উঠে সিনেমা। না বলা কথা, না বলা স্বপ্নকে প্রতিফলিত করে সিনেমা।
নাট্যজন প্রদীপ দেওয়ানজী বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে চলচ্চিত্রের যোগসূত্র আছে। জহির রায়হানের স্টপ জেনোসাইড ইতিহাসের অংশ। তিনি বলেন, মাঝখানে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণে পিছিয়ে পড়েছিল। বর্তমানে প্রযুক্তির বিকাশের কারণে আবারো সুযোগ তৈরি হয়েছে। তিনি বলেন, চলচ্চিত্র নির্মাণে সম্ভাবনা ও স্বপ্ন থাকলে হবে না। উদ্যোগ দরকার। এই উদ্যোগটাই নিয়ে চিটাগং শর্ট।
জুরি মেম্বার ও চলচ্চিত্র শিক্ষক হায়দার রিজভী বলেন, ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল আনন্দের। তবে পরিশ্রম এবং ডিসিপ্লিন ছাড়া হয় না। আর তা সফলভাবে করেছে চিটাগং শর্ট। দ্য সানশাইন এডুকেশন গ্রুপের চেয়ারম্যান সাফিয়া গাজী রাহমান বলেন, শুধু বিনোদন নয়, চলচ্চিত্রের মাধ্যমে সমাজের জন্য ম্যাসেজ থাকতে হবে। চলচ্চিত্রকারদের উৎসাহ প্রদানে চিটাগং শর্ট উদ্যোগের প্রশংসা করেন সামিট অ্যালায়েন্স পোর্ট লিমিটেডের সিনিয়র জেনারেল ম্যানেজার মাহিনুল হক।
চিটাগং শর্টের প্রতিষ্ঠাতা ইসমাইল চৌধুরী বলেন, বিশ্ববাসীর কাছে চট্টগ্রামকে তুলে ধরতে চিটাগং শর্ট নামকরণ করেছি। আমাদের লক্ষ্য ছিল চলচ্চিত্র নির্মাতা তৈরি করবো। কারণ, চলচ্চিত্র নিমাতা ফ্যাক্টরিতে তৈরি হয় না। তিনি বলেন, বাংলাদেশের তরুণ চলচ্চিত্রকারদের অনুপ্রেরণাদানের অংশ হিসেবে ২০১৫ সাল থেকে ‘মানবতার জন্য চলচ্চিত্র’ স্লোগানকে সামনে রেখে চলচ্চিত্র উৎসব আয়োজন করে আসছে আমাদের সংগঠন চিটাগং শর্ট।
অনুভূতি ব্যক্ত করেন শর্ট ফিল্মের নির্মাতা রানা মাসুদ, মেহেদী হাসান রানা, সাইফুল আলম বাপ্পী, গোলাম রাব্বানী, রুদ্রনীল আহমেদ। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পরপরই উৎসবের বিশেষ মাস্টারক্লাস পরিচালনা করেন চলচ্চিত্র নির্মাণ প্রশিক্ষক হায়দার রিজভী ও প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার রায়হান রাফি। ‘প্যাশন’ শিরোনামের মাস্টারক্লাসে রায়হান রাফি তার চলচ্চিত্রে আসার পেছনে যে নিষ্ঠা ও ভালোবাসা কাজ করেছে, সে বিসয়টিই তুলে ধরেছেন। তারপর দুপুর সাড়ে ১২ টা থেকে বিকেল সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত দেশ বিদেশ থেকে জমা পড়া চলচ্চিত্র থেকে অফিশিয়াল সিলেকশন হিসেবে নির্বাচিত ২১ টি চলচ্চিত্র। প্রায় হাউজফুল শো থেকে বের হয়ে দর্শকেরা পছন্দের বাংলা চলচ্চিত্রকে ভোট দিয়েছেন। যার উপর ভিত্তি করেই পিপলস চয়েস অ্যাওয়ার্ড দেয়া হয়। পঞ্চম চিটাগং শর্ট ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল ২০২০ এর ক্ষণগণনা শুরু করে উৎসবের সমাপ্তি ঘোষণা করেন ফেস্টিভ্যালের ডিরেক্টর শারাফাত আলী শওকত।
যারা পুরস্কার পেয়েছেন :
এদিকে জুরিবোর্ডের বিচারে এবার শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র নির্বাচিত হয়েছে ‘ইজ ইট গুড টু রান ওয়ে’ (তবে কি পলায়নেই মঙ্গল)। ছবিটির পরিচালক ফুয়াদুজ্জামান ফুয়াদ। সেরা পরিচালকের পুরস্কার পেয়েছেন ‘অর্ঘ্য’ ছবির নির্মাতা রুদ্রনীল আহমেদ। তার হাতে পুরস্কার তুলে দেন জ্যঁ-নেসার ওসমান এবং হায়দার রিজভী। দর্শকের বিচারেও ‘অর্ঘ্য’ ছবি সেরার খেতাব পেয়েছে। ‘অর্ঘ্য’ ছবিতে অভিনয় করে শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হয়েছেন অনিক দাস। তার হাতে পুরস্কার তুলে দেন নাজিমুদ্দীন শ্যামল এবং টিভি ব্যক্তিত্ব মেহেরীন নাজনীন। জয়া ছবিতে অভিনয় করে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রীর পুরস্কার জিতেছেন হুমায়ারা হিমু। এ অভিনেত্রীর প্রতিনিধির হাতে পুরস্কার তুলে দেন সামিট অ্যালায়েন্স পোর্ট লিমিটেডের পরিচালক এবং সিওও ক্যাপ্টেন কামরুল ইসলাম মজুমদার এবং রায়হান রাফি। বিদেশি ভাষায় নির্মিত ক্যাটাগরিতে সেরা চলচ্চিত্রের পুরস্কার জিতেছে ‘দ্যা রক স্টার’।