চট্টগ্রামের সাংবাদিক রুবেল খানের আড়াই বছরের শিশুকন্যা রাফিদা খান রাইফার মৃত্যুতে ম্যাক্স হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসকদের অবহেলা ও গাফিলতি পাওয়া গেছে। চট্টগ্রামের সিভিল সার্জনকে প্রধান করে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে।
কমিটি বৃহস্পতিবার রাত ৮টায় বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালকের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। প্রতিবেদনের একটি অনুলিপি দেওয়া হয়েছে চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নকে। শুক্রবার বেলা ১১টায় চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়ন সংবাদ সম্মেলন করে প্রতিবেদন সম্পর্কে বিস্তারিত জানানো হয়।
প্রতিবেদন জমা দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. আজিজুর রহমান সিদ্দিকী। তিনি বলেন, তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালায়ের মহাপরিচালকের কার্যালয়ে পাঠানো হয়েছে। এর অনুলিপি বিএমএ সভাপতি, চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি এবং চকবাজার থানার ওসিকে পাঠানো হয়েছে।
এই তদন্ত কমিটির সদস্যরা হলেন, সিভিল সার্জন ডা. আজিজুর রহমান সিদ্দিকী, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের শিশু স্বাস্থ্য বিভাগের প্রধান ডা. প্রণব কুমার চৌধুরী এবং চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের যুগ্ম সম্পাদক সবুর শুভ।
তদন্ত কমিটির এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ম্যাক্স হাসপাতালে সেদিন কর্তব্যরত চিকিৎসক, নার্স ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের দায়িত্বে অবহেলা এবং গাফিলতির প্রমাণ পাওয়া গেছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পরিচালক ডা. কাজী মো. জাহাঙ্গীর হোসেন পরিদর্শনের সময় ম্যাক্স হাসপাতালের যেসব ত্রুটি পেয়েছিলেন, সেগুলো তদন্ত কমিটির কাছেও ধরা পড়েছে । কমিটি ম্যাক্স হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স, মালিক কর্তৃপক্ষ ও হাসপাতালের কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে কথা বলে প্রতিবেদন তৈরি করেছে।
চট্টগ্রাম সাংবাদি ইউনিয়নের সংবাদ সম্মেলন
এদিকে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে উঠে আসা শিশু মৃত্যুর কারণ ও কমিটির করা সুপারিশ তুলে ধরতে শুক্রবার সকাল ১১টায় চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়ন। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের (সিইউজে) সাধারণ সম্পাদক হাসান ফেরদৌস।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, রাইফা’র বাবা-মা, ম্যাক্স হাসপাতালের চিকিৎসক-নার্স, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের লিখিত ও মৌখিক জবাবসহ মোট ১২ জনের বক্তব্য নিয়ে এবং সংশ্লিষ্ট নথিপত্র পর্যালোচনা করে তদন্ত প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে সাত দফা পর্যবেক্ষণের ষষ্ঠ দফায় বলা হয়েছে- শিশু বিশেষজ্ঞ ডা. বিধান রায় চৌধুরী শিশুটিকে যথেষ্ঠ সময় ও মনোযোগ দিয়ে পরীক্ষা করে দেখেননি। ডা. দেবাশীষ সেনগুপ্ত ও ডা. শুভ্র দেব শিশুটির গুরুতর অসুস্থ্যতার সময়ে আন্তরিকতার সাথে সেবা দেননি বলে পিতা-মাতা যে অভিযোগ করেছিলেন, তা এই তিন চিকিৎসকের বেলায় সত্য বলে প্রতীয়মান হয়।
চতুর্থ দফায় বলা হয়েছে- শিশু কন্যা রাফিদা খান রাইফা যখন তীব্র খিঁচুনিতে আক্রান্ত হয়, তখন সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের অনভিজ্ঞতা ও আন্তরিকতার অভাব দেখা হয় এবং ওই সময়ে থাকা সংশ্লিষ্ট নার্সদের আন্তরিকতার অভাব না থাকলেও এরকম জটিল পরিস্থিতি মোকাবেলা করার মতো দক্ষতা বা জ্ঞান কোনোটাই তাদের ছিল না। তবে, তদন্তে ভুল চিকিৎসার প্রমাণ মেলেনি বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনের তৃতীয় দফায় বলা হয়েছে- শিশু কন্যাকে ভর্তির সময় থেকে পরবর্তী যে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে তাতে রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা ব্যবস্থাপত্র ও ওষুধের প্রয়োগ যথাযথ ছিল।
তদন্ত প্রতিবেদনে ম্যাক্স হাসপাতালের চরম অব্যবস্থাপনার চিত্রও উঠে এসেছে। পঞ্চম দফায় বলা হয়েছে- শিশুকন্যা রাফিদা খান রাইফাকে অসুস্থতার জন্য ম্যাক্স হাসপাতালে জরুরি বিভাগে ভর্তি হওয়া থেকে শুরু করে শেষ চিকিৎসা পাওয়া পর্যন্ত প্রতিটা ক্ষেত্রে তার অভিভাবকের ভোগান্তি চরমে ছিল।
সপ্তম দফায় বলা হয়েছে- তদন্তে স্পষ্ট হয় যে, হাসপাতালে রোগী ভর্তি প্রক্রিয়ায় ভোগান্তি প্রকট। চিকিৎসক ও নার্সদের সেবা প্রদানের সমন্বয়হীনতা ও চিকিৎসাকালীন মনিটরিংয়ের অভাব দেখা যায়। অদক্ষ নার্স ও অনভিজ্ঞ চিকিৎসক নিয়োগের ফলে কাঙ্কিত চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা অনেক দুর্বল। বিশেষত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসা সেবায় বিশেষজ্ঞের সার্বক্ষণিক উপস্থিতির সংকট প্রবল।
প্রতিবেদনে চার দফা সুপারিশ করা হয়েছে। এতে চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগে তিন চিকিৎসকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া এবং ম্যাক্স হাসপাতালের সার্বিক ত্রুটিপূর্ণ চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা সংশোধনের কথা বলা হয়েছে। ওই হাসপাতালে ডিপ্লোমাধারী নার্স নেই উল্লেখ করা হয়েছে। ডিপ্লোমাধারী নার্সের মাধ্যমে চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করার সুপারিশ এসেছে প্রতিবেদনে। ম্যাক্স হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মাধ্যমে সার্বক্ষণিক দ্রুত সেবা নিশ্চিত করা এবং অভিভাবকদের রোগীর নিয়মিত আপডেট জানানোর কথাও বলা হয়েছে প্রতিবেদনের সুপারিশে।
প্রতিবেদন উপস্থাপনের পর হাসান ফেরদৌস বলেন, এই তদন্ত প্রতিবেদন আমরা গ্রহণ করছি এবং আমরা আশা করছি দ্রুত দায়ী চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ম্যাক্স হাসপাতাল বন্ধ করা হবে।
আমরা আবারও বলছি-সমগ্র বিএমএ’র বিরুদ্ধে আমাদের কোন আন্দোলন নয়। আমাদের আন্দোলন শুধুমাত্র দায়ী চিকিৎসক ও ম্যাক্স হাসপাতালের বিরুদ্ধে। আমাদের আন্দোলন সাংবাদিকদের সঙ্গে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণকারী বিএমএ নেতা ফয়সল ইকবাল চৌধুরী এবং উস্কানিদাতা বিএনপি-জামায়াতপন্থী আইনজীবী ডা. খুরশীদ জামিলদের বিরুদ্ধে। আমরা এই আন্দোলন অব্যাহত রাখব।
সংবাদ সম্মেলনে সিইউজে সভাপতি নাজিমউদ্দিন শ্যামল বলেন, আমরা আন্দোলন করে যাচ্ছি। আমাদের পিছু হটার কোন সুযোগ নেই। এক সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে সিইউজে সভাপতি বলেন, এই তদন্তে আমাদের সন্তুষ্ট বা অসন্তুষ্ট হওয়ার কোন সুযোগ নেই। এটা সরকারের প্রতিবেদন।
এসময় তদন্ত কমিটি সদস্য ও সিইউজের যুগ্ম সম্পাদক সবুর শুভ তদন্তের বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেন।
সংবাদ সম্মেলনে এছাড়া বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের সহ-সভাপতি শহীদ উল আলম ও যুগ্ম মহাসচিব তপন চক্রবর্তী, চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক শুকলাল দাশ এবং চট্টগ্রাম সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি মোস্তাক আহমেদ ও এজাজ ইউসুফী বক্তব্য রাখেন।
গত ২৮ জুন দৈনিক সমকালের চট্টগ্রাম ব্যুরোর জেষ্ঠ্য প্রতিবেদক রুবেল খানের আড়াই বছরের শিশু গলা ব্যাথায় আক্রান্ত রাফিদা খান রাইফাকে নগরীর মেহেদিবাগের ম্যাক্স হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ২৯ জুন রাতে শিশুটি মারা যায়। শুরু থেকেই রুবেল খান তার মেয়ের মৃত্যুর জন্য ভুল চিকিৎসা ও চিকিৎসকদের অবহেলাকে দায়ী করে আসছেন।
ঘটনার রাতেই সাংবাদিকরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে ম্যাক্স হাসপাতালের সামনে বিক্ষোভ শুরু করলে পুলিশ ডা.দেবাশীষসহ তিনজনকে আটক করে চকবাজার থানায় নিয়ে যায়। খবর পেয়ে বিএমএ চট্টগ্রাম জেলার সাধারণ সম্পাদক ডা.ফয়সল ইকবাল চৌধুরী কয়েকজনকে নিয়ে চকবাজার থানায় গিয়ে পুলিশ ও সাংবাদিকদের সঙ্গে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ করেন এবং আটকদের ছাড়িয়ে নিয়ে যান।
এসময় পুলিশের মধ্যস্থতায় ঘটনা তদন্তে চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. আজিজুর রহমান সিদ্দিকীর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। এতে বিএমএ ও সাংবাদিকদের প্রতিনিধিও ছিল। তবে বিএমএ পরে তাদের প্রতিনিধি প্রত্যাহার করে নেয়। কমিটিকে ৫ জুলাইয়ের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়।