চীন তাইওয়ানসহ কয়েকটি দেশ থেকে আমদানিকৃত কৃত্রিম ফুলের দাপটের কাছে সম্পূর্ণ অসহায় হয়ে পড়ছেন চন্দনাইশ–সাতকানিয়ার শত শত ফুলচাষি। মানে টেকসই এবং দামে কম হওয়ায় ফুল ব্যবসায়ীরাও তাজা ফুলের পরিবর্তে ঝুঁকছেন কাপড়ের তৈরি কৃত্রিম মনোলোভা ফুলের দিকে। আর এ কারণেই ফুলচাষিরা ফুলচাষ থেকে তাদের নিজেদের গুটিয়ে নেয়ার চিন্তাভাবনা শুরু করছেন।
জানা যায়, প্রায় দেড়যুগ আগে সাতকানিয়া উপজেলার খাগরিয়া ইউনিয়নের চরখাগরিয়া গ্রামে বাণিজ্যিকভাবে ফুল চাষ শুরু হয়। পরবর্তীতে এ চাষ ছড়িয়ে পড়ে চন্দনাইশ উপজেলার সাতবাড়িয়া ইউনিয়নের হাছনদন্ডি ও বৈলতলী ইউনিয়নের জাফরাবাদ এলাকাসহ বেশ কয়েকটি গ্রামে।
ইতোমধ্যে এ তিন ইউনিয়নের সহস্রাধিক কৃষক বাণিজ্যিকভিত্তিতে ফুল চাষ করছেন। এ চাষের মাধ্যমে তারা নিজেদেরকে স্বাবলম্বী করার পাশাপাশি পরিবারেও সচ্ছলতা ফিরিয়ে এনেছেন। কিন্তু গত কয়েকবছর থেকে হঠাৎ করে চীনসহ আরো কয়েকটি দেশ থেকে কাপড়ের তৈরি কৃত্রিম ফুল আমদানি শুরু হলে হুমকির মুখে পড়ে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদিত প্রাকৃতিক ফুলের উৎপাদন।
প্রতিবছর কৃত্রিম ফুলের আমদানি বাড়ার সাথে সাথে এ এলাকায় কমতে শুরু করে ফুলচাষ। কৃত্রিম ফুলের অব্যাহত আগ্রাসনে ঠিকতে না পেরে গত বছরে এখানকার বেশ কয়েকজন সফল ফুলচাষি ফুল চাষ বাদ দিয়ে অন্য পেশায় চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন।
সরেজমিনে চরখাগরিয়ায় গিয়ে দেখা যায়, মাত্র কয়েকবছরের ব্যবধানে এখানে ফুলচাষের জৌলুস অনেকটা কমে গেছে। আগে যেখানে চরখাগরিয়া গ্রামের আবাদি জমির বাইরে পতিত জমিগুলোতে নানা জাতের ফুল বাগানে ভরপুর ছিল এখন সেখানে শোভা পাচ্ছে অন্য ফসল। আমদানি করা কৃত্রিম ফুলের দাপটে অব্যাহত লোকসানের মুখে ফুল চাষের সাথে জড়িতরা এ পেশায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। এর ফলে ফুল চাষ সংকুচিত হয়ে আসছে বলে জানান চাষিরা।
ফুলচাষি আবু বক্করের সাথে আলাপ করে জানা যায়, আমদানি করা কৃত্রিম ফুলের আগ্রাসনে দেশিয় ফুলের চাষ ক্রমাগত সংকুচিত হয়ে আসছে। তিনি জানান, এখন আমদানি করা ফুল দিয়েই ভালোবাসা দিবসসহ জাতীয় দিবসগুলোর ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ ফুলের চাহিদা মিটে যাচ্ছে। দেশে চাষের মাধ্যমে উৎপাদিত ফুলের চেয়ে আমদানি করা ফুলের দাম কম এবং একাধিকবার ব্যবহারের সুবিধা থাকায় খুচরা ফুল বিক্রেতারা সেদিকেই ঝুঁকছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রায় দেড়যুগ আগে শুরু হওয়া এই ফুল চাষ লাভজনক হওয়ায় এখানে পর্যায়ক্রমে বাড়তে থাকে ফুলচাষির সংখ্যা। বর্তমানে দুই উপজেলার তিনটি গ্রামের প্রায় সহস্রাধিক কৃষক সরাসরি ফুলচাষের সাথে সম্পৃক্ত। এখানে মূলতঃ রজনিগন্ধা, গ্লাডিউলাস, হলুদগাদা, কাশিগাদা, লালগাদা, সেহেরিগাদা, বাসন্তি, চন্দ্রমল্লিকা, জিপসি, স্টার ও বোতামফুল উৎপাদন করা হয়।
এ এলাকায় উৎপাদিত এসব ফুল চট্টগ্রামের চেরাগিপাহাড় মোড়ে গড়ে উঠা ফুলের দোকানগুলোসহ চট্টগ্রাম বিভাগের অন্যান্য জেলা ও উপজেলাগুলোতে পাইকারিভাবে সরবরাহ করা হয়। আবার কিছু কিছু পাইকার নিজেরাই ফুল ক্ষেতে এসে ফুল সংগ্রহ করে। তবে সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন দেশ থেকে কৃত্রিম ফুল আমদানি শুরু হওয়ার পর থেকে চন্দনাইশ ও সাতকানিয়ার ফুলগ্রামগুলোতে উৎপাদিত ফুলের বিক্রি অস্বাভাবিকহারে কমে গেছে। ফলে ফুলচাষে বিনিয়োগকৃত অর্থ তুলে আনতেও হিমশিম খেতে হচ্ছে চাষিদের। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে ফুলের আমদানি বন্ধ করার কোনো বিকল্প নেই বলে জানালেন ফুলগ্রামের কয়েকজন বাসিন্দা।
ফুলচাষি আহমদ শফি, মোহাম্মদ রফিক, আবদুল গফুর, হেলাল উদ্দীন, আবদুল আলম, লেয়াকত আলী, মিন্টু মিয়া, মোহাম্মদ রিদওয়ানসহ আরো অনেকেই চীন, তাইওয়ান থেকে কৃত্রিম ফুলের আমদানি বন্ধ করে দেশিয় ফুলচাষকে টিকিয়ে রাখতে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকারের প্রতি আবেদন জানান।
তারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বাংলাদেশে উৎপাদিত কাঁচা ফুল যেখানে বিদেশে রপ্তানি হওয়ার কথা সেখানে কাগজ, কাপড় ও প্লাস্টিকে তৈরি কৃত্রিম ফুলের আমদানি বেড়ে যাওয়ায় দেশিয় ফুলচাষিদের অবস্থা অনেক শোচনীয়।সাতকানিয়া উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা শোয়েব মাহমুদ আমদানি করা প্লাস্টিক, কাগজ এবং কাপড়ের তৈরি ফুলের কারণে দেশিয় ফুলচাষিরা মার খাচ্ছে স্বীকার করে বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে কৃত্রিম ফুলের আমদানি বন্ধ করা হলেই দেশিয় ফুলচাষিরা রক্ষা পাবেন এবং এ ব্যাপারে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। আমদানি করা ফুলের আগ্রাসন রূখতে ফুলচাষিদেরকে নতুন নতুন জাতের ফুলচাষে উৎসাহিত করতে কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে নানাভাবে প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ দেয়া হচ্ছে বলেও জানান এই কর্মকর্তা।