কমে যাচ্ছে ভাপা পিঠা-খেজুর রস

বাঙ্গালির দীর্ঘদিনের সংস্কৃতি অংশ ভাপা পিঠা আর খেজুর রস। শীতের সকালে রসে ভিজিয়ে খোলা পিঠা, রসের সেমাই, কাঁচা রসের শিরনি, পায়েসসহ নানারকম মুখোরোচক খাবার কার না ভালো লাগে। শীতের মাত্রা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভোজনরসিকরা খুঁজতে থাকে রস ও রসের তৈরি গুড়। কয়েক বছর আগেও গ্রামে গাছিরা (খেজুরের রস বিক্রেতারা) রস ফেরি করে বেড়াতেন বিক্রির জন্য। এখন গ্রামে খুঁজতে হয় কোথায় খাঁটি রস বিক্রি হয়। রসের সন্ধান পেলেও এক সপ্তাহ আগে থেকে অগ্রিম টাকা দিয়ে রসের জন্য অর্ডার দিতে হচ্ছে। উপজেলায় আগে প্রতিটি গ্রামে খেজুর গাছ দেখা গেলেও জলবায়ু সহিষ্ণু এই উপকারী গাছটি এখন আগের মতো চোখে পড়ে না। জানা যায়, উপজেলার অন্যান্য ইউনিয়নের চেয়ে পাহাড়ী এলাকা কদলপুর, ডাবুয়া, হলদিয়া, পাহাড়তলী ও হালদা তীরবর্তী উরকিচর, পশ্চিম গুজরা, মোবারকখীল অঞ্চলে বেশি হয় খেজুর গাছ। বর্তমানে নানা প্রজাতির কাঠের গাছ লাগানোর ফলে নির্বিচারে কাটা হচ্ছে খেজুর গাছ। তাছাড়া খেজুর গাছ শুকনো অবস্থায় অন্যান্য জ্বালানি কাঠের চেয়ে বেশি জ্বলে বিধায় ইটভাটায় জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে এটি। মাত্র কয়েক দশক আগেও দেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো রাউজানের বিভিন্ন এলাকাতে প্রচুর পরিমাণ খেজুর গাছ ছিল। সে সময় পুকুরপাড়ে, গ্রাম্য সড়কের ধারে, বাড়ির উঠানে, ফসলি জমির আইল থেকে শুরু থেকে যত্রতত্র খেজুর গাছ চোখে পড়ত। তখন গ্রামে এমন কোনো পরিবার ছিল না, যাদের কমপক্ষে ৪-৫টি খেজুর গাছ নেই। সে সময় খেজুর গাছের আধিক্যের কারণে বহু খেজুর গাছ অবহেলায় পড়ে থাকত। গাছিরা সব গাছ কাটার সময় করে উঠতে পারতেন না। তারপরও যে পরিমাণ গাছ থেকে রস সংগ্রহ করা হতো তা গ্রামের প্রতিটি ঘর ছাড়াও সরবরাহ হতো দেশের বিভিন্ন শহরে। ফলে শীত মৌমুমে অনেকের জন্য রস সংগ্রহ ও বিক্রি ছিল একটি লাভজনক পেশা। গ্রামের কিছু গাছি এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে চুক্তি সাপেক্ষে গাছগুলো নিয়ে নিজেরা রস সংগ্রহ করে গাছের মালিকদেরও খাওয়াতেন। আর সেসব কিন্তু বিগত ১০-১৫ বছরে যেন সেই চিত্র উল্টে যেতে বসেছে। এখন উপজেলার পথে পথে ঘুরেও যত্রতত্র খেজুর গাছ চোখে পড়ে না। বাণিজ্যিক চাষ ও প্রশাসনের সুষ্ঠু তদারকি না করার ফলে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যের বাহক খেজুর গাছ আজ বিলুপ্তি পথে। এক সময় শীত এলেই খেজুরের রস ও রসের তৈরি মিঠার ঘ্রাণে গ্রামীণ জনপদ মৌ মৌ করত। শীত এলেই গাছিরা ব্যস্ত হয়ে পড়ত খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করার উপযোগী করতে। গাছিদের হাত ধরে তখন গ্রামের প্রতিটি ঘরে পৌঁছে যেত সুস্বাদু খেজুর রস। আর তা দিয়ে গ্রামের ঘরে ঘরে তৈরি হতো রসের মিষ্টান্ন ও রকমারি পিঠে-পুলি। রস বিক্রি করে গাছিরা শীত মৌসুমে বাড়তি কিছু টাকা আয় করে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতো। বিশেষ করে পৌষ-মাঘ মাস এলে গাছিদের আনন্দের সীমা থাকত না। খেজুরের রস সংগ্রহের জন্য মহাব্যস্ত হয়ে পড়তেন তারা। প্রতিদিন বিকেলে গাছে কলসি বা বোতল লাগিয়ে দিতেন রসের জন্য। আর পরেরদিন সকালে গিয়ে রস সংগ্রহ করে তা বিক্রি করতেন। ৮ থেকে ১০ বছর আগেও এক কলসি রস বিক্রি হতো ২৫ টাকায়। এখন এক কলসি রস বিক্রি হয় ৫০০ টাকা বা ৬০০ টাকায়। খেজুর গাছ কমে যাওয়ার ফলে বাড়ছে রসের দামও।
গাছিদের সাথে আলাপকালে জানা যায়, খেজুরের রস সিলভার দিয়ে বিশেষভাবে তৈরি ঢালায় (ভাপা পিঠা) রেখে আগুন দিয়ে ৪-৫ ঘণ্টা উত্তপ্ত করতে হয়। অনেকক্ষণ গরম হওয়ার ফলে রস একটা সময় মিঠায় পরিণত হয়। প্রতি ৫ লিটার রস দিয়ে এক কেজি মিঠা (স্থানীয় ভাষায় রাভ মিঠা) করানো হয়। প্রতি কেজি মিঠা স্থানীয় বাজারগুলোতে বিক্রি করা হয় ৩০০-৪৮০ টাকায়। এ বিষয়ে পরিবেশবাদী নেতা নুরুল আবছার বলেন, খেজুর গাছ উপজেলার পাহাড়ী এলাকায় বেশি লাগানো হতো। কিন্তু ক্রমেই এটি এখন বিলুপ্তির পথে। রস বিক্রির পাশাপাশি খেজুরের রসে গুড়ও ছিল অত্যন্ত জনপ্রিয়। কিন্তু কালের বিবর্তনে খেজুর গাছ হারিয়ে যাচ্ছে। পূর্ব গুজরা ইউনিয়নের এক গাছি নুরুল ইসলাম বলেন, আমার নিজস্ব কোনো খেজুর গাছ নেই। গ্রামের যেসব খেজুর গাছ শীত মৌসুমে খোলা (রসের জন্য প্রস্তুত করা) হয় না আমি সেগুলো খুলি। রস যা পায় একদিন আমি নেই পরের দিন গাছের মালিক নেয়। রাতে খেজুরের রস বাদুর বা অন্য কোনো পাখি যাতে খেতে না পারে সেজন্য বোতলকে বিশেষভাবে বসানো হয়। খেজুর গাছ আগের তুলনায় অনেক কমে গেছে। এখন রসও তেমন পাই না। তাছাড়া গাছে রসের জন্য কলসি বসানোর পর সারারাত পাহারা দিতে হয়। না হলে রস চুরি হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। খেজুরের রস পাঁচ লিটার বিক্রি করা হয় ২৫০ টাকা। আর রসের গুড় বিক্রি করা হয় প্রতি কেজি ২০০-২৮০ টাকায়। খেজুরের রসে রয়েছে প্রচুর খনিজ ও পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ। শারীরিক দুর্বলতা কাটিয়ে কর্মস্পৃহা ফিরিয়ে আনতে খেজুরের রস দারুণ উপকারী। বাংলাদেশে যে খেজুর হয় তাতে যথেষ্ট শাঁস থাকে না বলে অনেকেই এটা খেতে খুব একটা পছন্দ করেন না। খেজুরের রস থেকে তৈরি গুড় অনিদ্রা ও কোষ্ঠকাঠিন্য দ‚র করতে গুরুত্বপ‚র্ণ ভ‚মিকা পালন করে। খেজুরের গুড়ে আয়রন বা লৌহ বেশি থাকে এবং হিমোগ্লোবিন তৈরিতে সহায়তা করে। সারা বছর খেজুরের রস সংগ্রহ করা যায়। তবে শীতকালের খেজুরের রসই বেশি সুস্বাদু। শীত কমার সঙ্গে সঙ্গে রসের পরিমাণ ও মানও কমতে থাকে।