সেঞ্চুরি পূর্ণ করার পর হেলমেট খুললেন, ব্যাটটাকে দুহাতে কোলে নিয়ে দোল খাওয়ালেন। ইমরুল কায়েসের অমন উদযাপনের কারণটা বুঝতে অসুবিধা হলো না। কয়েক সপ্তাহ আগে পুত্রের জনক হয়েছেন, বাংলাদেশ দলের বাঁহাতি ওপেনার সদ্যজাত পুত্রকেই সেঞ্চুরিটা উৎসর্গ করলেন। ইমরুলের ওই স্মরণীয় সেঞ্চুরির মাহাত্ম্য এদিন টাইগারদের জন্য ছিল আরও বেশি। ব্যাটিংয়ে ধুকতে থাকা স্বাগতিকদের পথের দিশা দেখিয়েছেন তিনিই। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে তিন ম্যাচ সিরিজের প্রথমটিতে বাংলাদেশের ২৮ রানের অনায়াস জয়ের রূপকার ইমরুলের ওই সেঞ্চুরিই।
এক সময়কার প্রবল প্রতিপক্ষ জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে এখন বাংলাদেশের জয় দেখা অনেকটা ডাল-ভাতের মতো ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই জয় নয়, ওই দলটির বিপক্ষে হারলেই সেটা বড় খবর হয়। বাংলাদেশের ব্যাটিংয়ের শুরুতে এদিন তেমন হারের আবহই তৈরি হয়েছিল। ১৭ রানে ২ উইকেট পড়ল, ঝুলিতে ১৩৯ রান জমা হতেই সাজঘরে প্রথম সারির ৬ ব্যাটসম্যান। রীতিমতো ঘোর বিপাকে পড়া দলকে ক্যারিয়াসেরা ১৪৪ রানের ইনিংসে টেনে তুলেছেন ইমরুল। মোহাম্মদ সাইফউদ্দিনের সঙ্গে সপ্তম উইকেটে রেকর্ড ১২৭ রানের জুটি গড়ে বাংলাদেশকে এনে দিয়েছেন ২৭১ রানের ম্যাচজয়ী পুঁজি।
ক্ষণে ক্ষণে রঙ পাল্টানো মিরপুর শেরেবাংলার উইকেটে জিম্বাবুয়ের ব্যাটসম্যানদের সামনে ২৭২ রানের জয়ের লক্ষ্যটাকে পাহাড়সম করে তোলেন বোলাররা। দলপতি মাশরাফি বিন মর্তুজার আক্রমণাত্মক কৌশল প্রসংশা পাওয়ার মতোই ছিল। মুস্তাফিজুর রহমান যখন বোলিং করছিলেন, স্লিপ কর্ডনে জনা চারেক ফিল্ডারকে ফিল্ডিং করতে দেখাÑ বাংলাদেশের ক্রিকেট অনুরাগীদের চোখকে নিশ্চিতকরেই প্রশান্তি দিয়েছে। স্পিনারদের জন্যও মাঝেমধ্যে দুটো স্লিপ রেখেছেন মাশরাফি। বোলিংয়ে জিম্বাবুয়েকে কতটা চাপের মধ্যে রেখেছে বাংলাদেশ, এটা তারই প্রমাণ।
শুরুতে চিপাস জুয়াও (২৪ বলে ৩৫) মাশরাফি আর মেহেদী হাসান মিরাজের ওপর কিছুটা চড়াও হয়েছিলেন। তাতে বোলিংয়ের মতো ব্যাটিংয়েও শুরুটা ভালো পেয়েছে জিম্বাবুয়ে। তবে শুরুর ভালো নয়, ‘শেষ ভালো’টাই তো আসল। এদিনও আসল কাজটা নিজেদের মতো করেই সেড়েছে টাইগাররা। মুস্তাফিজের দুর্দান্ত এক ডেলিভারিতে জুয়াও সরাসরি বোল্ড, এরপর সময় যত গড়াল ম্যাচটা ততোই হেলে পড়ল বাংলাদেশের দিকে। আনুষ্ঠানিক সমাপ্তির অনেক আগেই ম্যাচে বাংলাদেশের জয় লেখা সাড়া। কাইল জার্ভিস (৩৭) আর শন উইলিয়ামস (৫০*) শেষদিকে চেষ্টা চালিয়েছিলেন। তাদের চেষ্টাতেই টেনেটুনে ২৪৩ পর্যন্ত যেতে পেরেছে জিম্বাবুয়ে।
জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে এই নিয়ে টানা ১১ ম্যাচ জিতল টাইগাররা। তাতে তিন ম্যাচের সিরিজে ১-০ ব্যবধানে এগিয়ে থেকেই চট্টগ্রামে যাচ্ছে তারা। টাইগারদের এই অগ্রগামীতার মুল নায়ক একজনইÑ ইমরুল। পার্শনায়ক অবশ্য একজন নয়। মোহাম্মদ সাইফউদ্দিন, নাজমুল ইসলাম অপু, মোহাম্মদ মিঠুন, মিরাজ আর মুস্তাফিজও। বোলিংয়ে দুর্দান্ত ছিলেন অপু। ব্রেন্ডন টেলর আর সিকান্দার রাজাকে যে দুটো ডেলিভারিতে বোল্ড করলেন, সেটা তার নাগিন নাচের থেকেও মনোমুগ্ধকর ছিল। শুরুর ধাক্কা সামলে যেভাবে ছন্দে ফিরলেন মিরাজ, সেটাও প্রসংশার দাবি রাখে। ২৪ রান করে ক্রেইগ আরভিন আর ২৬ রানের ইনিংসে জিম্বাবুয়েকে ক্ষীণ আশা দেখানো পিটার মুরকে নিজের শিকার বানিয়েছেন এই অফস্পিনার। পরে ব্রেন্ডন মাভুতাকে (২০) আউট করে নিজের বোলিং কোটা শেষ করেছেন ৪৬ রান খরচায় ৩ উইকেট নিয়ে।
ফিল্ডিংয়েও টাইগাররা ছিল স্বপ্রভিত। দুটো রানআউট তারই প্রমাণ। ইমরুলের থ্রুতে যেভাবে জিম্বাবুয়ে দলপতি হ্যামিল্টন মাসাকাদজাকে রানআউট করলেন মুশফিকুর রহিম, সেটা ছিল চোখে লেগে থাকার মতো। ২১ রান করা মাসাকাদজার রানআউটেই জিম্বাবুয়ের দারুণ শুরুটা মিলিয়ে যেতে থাকে। টাইগার বোলাররা মেলে ধরেন তাদের পসরা। তাতেই স্বস্তির জয় টিম বাংলাদেশের। তবে ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতা কিন্তু বড় অস্বস্তি হয়েই থাকছে। মিঠুন আর সাইফউদ্দিনকে নিয়ে ইমরুল ওভাবে লড়াই গড়তে না পারলে ম্যাচের চিত্রনাট্য কিন্তু ভিন্নও হতো পারতো।
তামিম আর সাকিব দলে নেই চোটের কারণে। আট মাস পর নিজেদের আঙিনায় খেলতে নামা বাংলাদেশের ব্যাটিং তাতেই বেশ নড়বড়ে দেখাল। এশিয়া কাপের ফাইনালে সেঞ্চুরি করে আসা লিটন দাসকে চেনাই গেল না। ৪ রান করে আত্মহুতি দিয়েছেন টেন্দাই চাতারার বলে। ওই ওভারের শেষ বলেই উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিয়েছেন অভিষিক্ত ফজলে রাব্বি। রানের খাতা না খোলার আগেই এই বাহাতি ফিরেছেন সাজঘরে। থিতু হতে পারেননি মুশফিকও, ১৫ রান করে আউট হয়েছেন দলের বিপদ বাড়িয়ে। মিঠুনের সঙ্গে ৭১ রানের চতুর্থ উইকেট জুটিতে বিপদটা দূরে ঠেলেছিলেন ইমরুল। কিন্তু ২ রানের ব্যবধানে কাইল জার্ভিসের শিকার হয়ে তিন ব্যাটসম্যানের সাজঘরে ফেরা; দিয়েছিল অশনি সংকেত।
আক্রমণাত্মক ব্যাটিংয়ে ৩৭ রান করা মিঠুন ২৮তম ওভারের দ্বিতীয় বলে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিয়েছেন। চার বল পর মাহমুদউল্লাহও তাই করলেন। ৩০তম ওভারের তৃতীয় বলে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটালেন মিরাজ। ৩ উইকেটে ১৩৭ থেকে মুহূর্তেই ৬ উইকেট ১৩৯ বাংলাদেশ। দলের পুঁজি ২০০ পাড় হবে কিনা, তাই নিয়েই শঙ্কা তখন। তবে সহযাত্রীদের একে একে ঝরে পড়তে দেখেও ইমরুল ছিলেন অবিচল। একপাশ আগলে দুর্দান্তভাবে ব্যাট চালিয়ে গেছেন। লিটন দাসের সঙ্গে ইনিংসের সুচনায় নেমেছিলেন। ১৪০ বলে ১৩টি চার আর ৬টি ছক্কায় ১৪৪ রানের অনবদ্য ইনিংস খেলে যখন সাজঘরে ফিরলেন, ইনিংসের তখন ৮ বল বাকি।
ইনিংসটি ইমরুলের ক্যারিয়ারসেরা। শেষতক টিকে থাকলে হয়তো তামিমের ১৫৪ রানের ইনিংসটাও টপকে যেতে পারতেন, ওয়ানডেতে এখনো যেটা বাংলাদেশের পক্ষে সর্বোচ্চ। ওইটুকু ছাড়া ইমরুলের ব্যাটিংয়ে এদিন আক্ষেপ করার ন্যুনতম অবকাশ নেই। ব্যাট হাতে কেবল মুদ্ধতাই ছড়িয়েছেন। ক্যারিয়ারের প্রথম হাফসেঞ্চুরিতে মনজয় করেছেন সাইফউদ্দিনও (৬৯ বলে ৫০)। বল হাতেও মিতব্যায়ী ছিলেন। সত্যিকারের এক অলরাউন্ডারের মতোই পারফর্ম করেছেন এই তরুণ। নিজেদের ৩৫০তম ওয়ানডেতে জয়ের পাশাপাশি সাইফউদ্দিনের ফিরে আসাও তাই বাংলাদেশের প্রাপ্তি। সবথেকে বড় প্রাপ্তি নিশ্চিতকরেই ইমরুলের অমন মহাকাব্যিক ইনিংস।
সংক্ষিপ্ত স্কোর
বাংলাদেশ : ৫০ ওভারে ২৭১/৮ (ইমরুল ১৪৪, সাইফউদ্দিন ৫০, মিঠুন ৩৭, মুশফিক ১৫; জার্ভিস ৪/৩৭, চাতারা ৩/৫৫, মাভুতা ১/৪৮)
জিম্বাবুয়ে : ৫০ ওভারে ২৪৩/৯ (উইলিয়ামস ৫০*, জোয়াও ৩৫, পিটার মুর ২৬, আরভিন ২৪, মাসাকাদজা ২১, মাভুতা ২০; মিরাজ ৩/৪৬, নাজমুল অপু ২/৩৮, মাহমুদউল্লাহ ১/২৪, মুস্তাফিজ ১/২৯)
ফল : বাংলাদেশ ২৮ রানে জয়ী।
ম্যাচসেরা : ইমরুল কায়েস।