নির্বাচনে বৃহন্নলাদের কদর বাড়ে !

চাঁদাবাজি নিয়ে হিজড়াদের হাতে নাজেহাল হওয়ার ঘটনা প্রায় দেখা যায়। গণমাধ্যমেও প্রচার করা হয় বিভিন্ন সময়। হিজড়ারা যে আমাদের এই সমাজে একটা বিড়ম্বনার নাম তা নিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু কেন বৃহন্নলারা এমন জীবন বেছে নেন? সেটি কি কখনো ভেবেছেন? পরিবার থেকে শুরু করে সমাজের সবখানে তারা কেবল অপমান, উপহাস, তাচ্ছিল্য আর নিগ্রহের শিকার হন। তারা কি সমানাধিকার পাচ্ছে? সম্মানজনক সেই জায়গা আমরা কি তৈরি করে দিতে পেরেছি? নিশ্চিত করতে পেরেছি কি তাদের অধিকারগুলো ?

সম্প্রতি সীতাকুণ্ডে রেডিও সাগরগিরি’র নারী সাংবাদিক প্রিয়াংকারাণী দেবী মুখোমুকি হন মুন্না হিজড়ার। সাক্ষাৎকারটিতে উঠে এসেছে বিভিন্ন বিষয়। পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটি হুবহু তুলে ধরা হলো।

আমার নাম মুন্না। পিতা আব্দুর রশিদ, মাতা রহিমা বেগম। জন্ম চট্টগ্রামের দেওয়ানহাটে। কিন্তু বড় হয়েছি সীতাকুণ্ড পৌরসভার ৩নং ওয়ার্ডে। ওয়ার্ড কমিশনার হচ্ছে আজাদ। প্রায় ১৬ বছর ধরে সারগিদদেরকে নিয়ে সীতাকুণ্ডে বসবাস করছি। দুই-চার-পাঁচ টাকা খুঁজে আনি। তা দিয়েই জীবনযাপন করছি।

উপজেলা থেকে যেসকল সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে সেগুলো কি পাচ্ছেন কিনা জানতে চাইলে বলেন,আমরা কোন কিছুই উপজেলা থেকে পাই না। এমনকি থানা প্রশাসনের কাছ থেকে ইউনিয়ন থেকে, পৌরসভা থেকে, কোন চেয়ারম্যান, মেয়র, কাউন্সিলর, মেম্বার কেউ কোন সহযোগিতা করছে না। কোনো কিছুই পাচ্ছি না। আমাদেরকে সহযোগিতা করে সাধারণ মানুষ। জনগণের কাছ থেকে চেয়ে নেওয়া টাকায় আমরা বেঁচে আছি। জনগণ যদি আমাদের দিকে না তাকায় তাহলে আমরা এখানে কখনো থাকতে পারতাম না। মা-বাবা আপনারা,ভাইবোন আপনারা। নির্বাচন আসলে চেয়ারম্যান-মেম্বাররা বলেন তোমাদেরকে শাড়ী দেব, ব্লাউজ দেব, চুড়ি দেব, সেলাই মেশিন কিনে দেব এসব কিছুই লোক দেখানো। আমাদের নাম বিক্রি করা হয়।
একবার শুধু স্ব-ইচ্ছায় পৌরসভায় গেলে ৫ কেজি চাল পেয়েছিলাম। সেটা আবার মন চাইলে দেয় আবার না চাইলে নাই। বছরে এতো টুকুুন সুযোগ থেকেও আমরা বঞ্চিত হয়ে থাকি।

তবে ইতোমধ্যে আমাদের এখানে গতবার নির্বাচনে কাউন্সিলর প্রার্থী ছিলো জেসমিন। তিনি নির্বাচিত হন নাই। তাকেই দেখেছি পৌরসভায় কিছু আসলে আমাদের ডেকে নিয়ে দেন। সেখানে আমাদের কার্ডও লাগতো না। আমাদেরকে তিনি ২০ কেজি চাল দিয়েছিলেন।

ছোটবেলা থেকে ইচ্ছা ছিলো লেখাপড়া করে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর। কিন্তু আমার বাবা আরেকটি বিয়ে করে আমার মাকে ফেলে চলে যায়। তখন আমার মাকে ভিন্ন হয়ে যেতে হয়। তখন ওখানে আমার এক বড় ভাই ছিলো। তখন কোথাও নাচলে ১১০-১৩০ টাকা করে পেতাম। এরই মধ্যে ওখানে আমার একটা ছেলের সঙ্গে সম্পর্ক হলে লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে চট্টগ্রামে চলে আসি। চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার চলে যাই। ওখানে একটা হিজরার সঙ্গে পরিচয় হয়। সেখানে গিয়ে ভয় পাই। তবে আমার সবচেয়ে প্রিয়জন হচ্ছে আমার নানগুরু। আমার মা-বাবার চাইতেও বেশি ভালো বাসে। পরিবারের সদস্যদের যে আদর যত্ন থেকে বঞ্চিত হয়েছি তা পূরণ করেন আমাদের নানগুরু।

সমাজের মানুষ আমাদের বিভিন্ন রকম দৃষ্টিতে দেখে। আমাদের প্রতিবন্ধী মনে করেন অনেকে। অনেকে মনে করেন আমাদের স্ত্রী নেই, স্বামী নেই। আমরা যদি তাদের ৫-১০ টাকা না দেই তাহলে ওরা কিভাবে চলবে। আবার অনেকে চিন্তা করেন ওরা হিজরা, ওরা বিশৃঙ্খলা করে ওদের টাকা দিয়ে বিদায় করলেই ভালো। কথায় আছে ভালো পোশাকে আছে ভদ্রতার পরিচয় আর ভালো ব্যবহারে আছে বংশের পরিচয়। কার দৃষ্টিতে কিভাবে আমাদের দেখছে সেটাতো জানি না। মা হলেও আপনারা, বাবা হলেও আপনারা, ভাই হলেও আপনারা, বোন হলেও আপনারা। আপনারা আমাদের জন্য যতটুকু করবেন আমরাও আপনাদের জন্য চারগুন বেশি করবো। আপনাদের কাছে চিরঋণী থাকবো । আজকে যদি আমি আপনার ভাই হতাম, তাহলে কি আপনি আমাকে ফেলে দিতেন, যদি প্রতিবন্ধী হতাম তাহলে কি আপনি ফেলে দিতেন।

সরকারের কাছে আমাদের একটাই দাবী আমাদেরকে কাজ করার সুযোগ দেওয়া হোক। যাতে আমার সারগিদদেরকে নিয়ে ফিল্ডে কাজ করতে পারি। আপনাদের কাছে অনুরোধ আমাদেরকে একটি কর্মসংস্থানে সুযোগ করে দিবেন।

পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পিছনে কারণ কি জানতে চাইলে মুন্না বলেন, পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হতে বাধ্য হয়েছি। বাধ্য হয়েছি কারণ, ছোট বেলায় যখন আমাকে খৎনা করাতে নিয়ে যায় তখন খৎনা করাতে পারে নাই। এ নিয়ে বিভিন্ন জনে বিভিন্ন কথা বলতো। প্রতিবেশীরা আমার মাকে বলতে থাকে তোমার ছেলে হিজরা। এটা নিয়ে আমার মামা আমার মাকে সম্পত্তি থেকে পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ার পায়তারা করে। আমার মামা মাকে বলতে শুনতাম তোর ছেলে হিজরা। আমার মামা মায়ের সঙ্গে প্রায় ঝগড়া করতো। ক্ষোভ ঝেরে বলতোল হয়তো তোর ছেলে থাকবে অথবা তুই থাকবি এই বাড়িতে। তোর ছেলের জন্য আমার মেয়ের বিয়ে হবে না, আমার আরও ছেলেরা নষ্ট হয়ে যাবে। এগুলো শোনার পর আমি নিজেই স্ব ইচ্ছায় মাকে ফেলে চলে আসি। এলাকায় আমাকে নিয়ে ষড়যন্ত্র শুরু হয়ে যায়। চুরি না করলেও বলতো আমি চুরি করেছি। এগুলো আর সহ্য করতে না পেরে বাসা থেকে চলে আসি। কিন্তু চলে আসার সময় আমার মা অনেক কান্নাকাটি করেছে।

তিনবছর ধরে অসুস্থ আমি। পৃথিবীতে আমার মা ছাড়া আর কেউ নেই। এরপরও আমার সারগিদ যারা আছে তারা আমাকে টাকা তুরে। উপজে লা প্রশাসন থেকে যআিমাদের কোন ট্রেনিংয়ে ডাকা হয় না। যদি আমাদের করার সুযোগ করে দেয়া হয় সেখানে অবশ্যই অংশ নেবো। ভাতা আমাদের অবশ্যই প্রয়োজন রয়েছে।

সমাজে আমাদের নিয়ে দুর্নাম রয়েছে তা একবাক্যে শিকার করব। তবে আমি যদি উদাহরণ দিয়ে বলি, একটা বাড়িতে বাচ্চা হয়েছে সেখানে খুশি করে দান দক্ষিণা হিসেবে ৫০০-১০০০ টাকা করে দেন। কিন্তু সেখানে যদি ৫০০০ টাকা ১০০০০ টাকা চাই। তারা কিভাবে দেবে। ঐ পরিবারের পক্ষেতো সম্ভব নয়। সেখানে জোর কেন করব? তবে সবাই এক নয়। সীতাকু-ে না থাকলেও চট্টগ্রাম শহরে, মিরসরাইয়ে এমন অনেক হিজরা রয়েছে যাদের চার- ছেলে-মেয়ের জননী। কিন্তু তারা হিজরা দাবী করে। এ বিষয়গুলো দেখা যায় আমাদের বিড়ম্বনায় ফেলে দেয়। আমাদের যে হিজরা সনদ রয়েছে তাতে লেখা রয়েছে সহযোগিতা করার জন্য সুপারিশ করা হয়েচে। কোন নির্দিষ্ট অংকের টাকাতো দেওয়া কথা বলা হয়নি।

সীতাকুণ্ডে হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে সরকারী পদক্ষেপ সম্পর্কে বলেন উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা লুৎফুন নেছা বেগম বলেন, হিজড়াদের ঘরের কোণে নয় তাদেরকে অবহেলা করে নয় তাদেরকে মূল শ্রোতধারায় তাদেরকে নিয়ে আসার জন্য বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ চালু করেছেন ভাতা চালু করেছেন সমাজসেবা অধিদপ্তর। উল্লেখ করতে চাচ্ছি তারা মাসে ৬০০ টাকা করে ভাতা পেয়ে থাকেন। এভাবে কিন্তু হিজরাদের মূলশ্রোতধারায় নিয়ে আসার জন্য চেষ্টা করছি। এবং জরিপে গত ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে ২জন রয়েছে এবং২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে ৩ জনের লিস্ট আমরা হাতে পেয়েছি। অর্থাৎ ৫জনকে তালিকাভূক্ত করেছি।বাংলাদেশের ৬৪টি জেলার প্রায় প্রত্যেকটি জেলায় হিজড়াদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। এবং চট্টগ্রাম জেলার যে সমাজসেবা কার্যালয় রয়েছে সেখানে ৫০ দিন ব্যাপী প্রশিক্ষণ কর্মসূচি ইতিমধ্যেই পরিচালিত হয়েছে । সেখানে হিজড়াদেরকে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ যেমন ড্রাইভিং, বেকারি, পার্লারের কার্যাবলী প্রশিক্ষণ তাদের দেওয়া হচ্ছে যাতে তারা কাজের মাধ্যমে অর্থনৈতিক স্বাবলম্বী হতে পারে। এসব কাজের সঙ্গে তাদের অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও ঋণ এই বিষয়গুলো ধিরে ধিরে সংযুক্ত হচ্ছে।